চাল, গম, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও চিনি—শেষ পর্যন্ত এই ছয় পণ্য আমদানিতে ভারতের কাছে কোটা চেয়েছে বাংলাদেশ। বছরে মোট ৫২ লাখ ৫০ হাজার টন পণ্য আমদানিতে কোটা চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টন হবে গম। ভারতের পক্ষ থেকে কোটা সুবিধা দেওয়া অবশ্য নতুন কিছু নয়। তারা এর আগে প্রতিবেশী ভুটান ও মালদ্বীপকে এ ধরনের কোটা দিয়ে আসছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুযায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় পণ্য আমদানিতে কোটা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। এর মধ্যে চাল ১৫ লাখ টন, গম ২০ লাখ টন, চিনি ১০ লাখ টন, পেঁয়াজ ৬ লাখ টন, আদা ১ লাখ টন ও রসুন ৫০ হাজার টন আমদানিতে কোটা চাওয়া হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, চালের কোটায় ৮ থেকে ১০ লাখ টন আমদানি করা হবে সরকারিভাবে। বাকিটা আমদানি করবে বেসরকারি খাত। আর গমের কোটায় সরকার ৫ থেকে ৭ লাখ টন আনবে, বাকিটা আসবে বেসরকারিভাবে। বাকি চার পণ্যের ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কে কী পরিমাণ আমদানি করবে, তা উল্লেখ করা হয়নি।
জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ শনিবার বিকেলে মোবাইলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পণ্যওয়ারি কোটা চাহিদার কথা সম্প্রতি আমরা ভারতকে জানিয়েছি। আশা করছি, ইতিবাচক থাকবে ভারত। দেশটির জবাবের অপেক্ষায় আছি।
ভারত থেকে নিত্যপণ্য আমদানিতে কোটার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ অবশ্য আরও আড়াই মাস আগে আলোচনা করেছে। ভারত হঠাৎ করে একবার পেঁয়াজ, আরেকবার গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বাংলাদেশ খুব বিপদে পড়ে। একে ভিত্তি ধরেই গত ২২-২৩ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে উল্লিখিত ছয়টি নিত্যপণ্যসহ ডাল আমদানিতে কোটা চেয়েছে বাংলাদেশ।
তখন চালে ২০ লাখ টন, গমে ৪৫ লাখ টন, পেঁয়াজে ৭ লাখ টন, চিনিতে ১৫ লাখ টন, আদায় দেড় লাখ টন, ডালে ৩০ হাজার টন ও রসুনে ১০ হাজার টনের কোটা চাওয়া হয়। জবাবে ভারত ওই বৈঠকেই জানিয়ে দেয়, পণ্য তারা বিক্রি করবে, কোটাও রাখতে রাজি। তবে পরিমাণটা গুরুত্বপূর্ণ। সে অনুযায়ী তারা কোন পণ্যের জন্য কী পরিমাণ কোটা লাগবে, তা সুনির্দিষ্ট করে জানাতে বলেছে বাংলাদেশকে। কারণ, আগের কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলে না যে বছরে এত পণ্য আমদানির দরকার পড়বে বাংলাদেশের। বৈঠক থেকে ফিরে এসে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন।
এরপরই পণ্যের চাহিদা নির্ণয় করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নূর মো. মাহবুবুল হককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। কমিটিতে খাদ্য, কৃষি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের একজন করে প্রতিনিধি রাখা হয়।
ওই কমিটি ভারত থেকে গত ১০ বছরে পণ্য আমদানির চিত্র বিশ্লেষণ শেষে ছয় পণ্যের মোট পরিমাণ ও পণ্যওয়ারি পরিমাণ নির্ধারণ করে। ডালের ব্যাপারে শুরুর দিকে কোটা চাওয়া হলেও চূড়ান্ত চিঠিতে সেটাকে বাদ রাখা হয়েছে। কারণ, ভারত ডিসেম্বরের বৈঠকেই জানায় যে নিজেদের চাহিদার কারণেই ডাল রপ্তানি তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে। তার আগের অর্থবছরে দেশটি থেকে আমদানি করা হয় ৮৫৯ কোটি ডলারের পণ্য।
এদিকে দেশে চালের উৎপাদন ও চাহিদা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর আলাদাভাবে যেসব হিসাব দেয়, সেগুলো নিয়ে একধরনের বিভ্রান্তি আছে। যেমন বিশেষ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের ফারাক থাকে। যে কারণে চালের বার্ষিক উৎপাদন ও চাহিদার যথাযথ তথ্য পাওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এ বছর বাংলাদেশের চালের চাহিদা হচ্ছে ৩ কোটি ৭০ লাখ টন।
জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম এ সাত্তার মণ্ডল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে হয়তো সিদ্ধান্তটি ঠিক আছে। কিন্তু এ-ও মনে রাখতে হবে যে কোনো কোনো কোটা বাজারকে প্রভাবিত করে এবং প্রতিযোগিতাকেও ব্যাহত করে। তাই আমদানির সময়, পরিমাণ ও মূল্য পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। দেশে একটা পণ্যের ফলন ভালো হলে এবং কোটা সুবিধা থাকায় যদি আবার সেই পণ্য আমদানি করতেই হয়, তাহলে কিন্তু দামের দিক থেকে স্থানীয় বাজারে ওই পণ্যটির দামে ধস নামবে। সে জন্য ব্যবস্থাটির নমনীয়তা থাকাটাও জরুরি।
সূত্র :প্রথম আলো