চাঁদপুরের জামাল মিয়া, সালাউদ্দিন ও জামালপুরের ইমরান হোসেন বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) আজমান রাজ্যে থাকেন। সম্প্রতি এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তাঁরা তিনজনে মিলে ৫০ কিলোমিটার দূরে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা দেখতে আসেন। তাঁদের মধ্যে জামাল মিয়া ও সালাউদ্দিন এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশটিতে আছেন, বেতন গড়ে দেড় হাজার দিরহাম। ইমরান হোসেন এসেছেন সম্প্রতি, তাঁর বেতন ৯০০ দিরহাম। তিনজনই একই কোম্পানিতে কাজ করেন।
বুর্জ খলিফা সন্ধ্যা বেলকার অপরূপ দৃশ্য দেখতে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও প্রান্তের প্রচুর মানুষ ভিড় করেন। বাংলাদেশের তিন প্রবাসী শ্রমিক জামাল, সালাউদ্দিন ও ইমরান গত ২২ ফেব্রুয়ারি সেখানে আসেন। ভিডিও কলে তাঁরা বাড়ির লোকদের বুর্জ খলিফার আলোকসজ্জা ও আলোঝলমল ফাউন্টেন বা ঝরনা দেখান।
কাছে গিয়ে ‘দেশি ভাই’ বলে সম্বোধন করতেই কথা বলতে আগ্রহ দেখান তিনজন। জামাল মিয়া ও সালাউদ্দিন জানান, দেশটিতে এক বছরের বেশি সময় ধরে থাকলেও এই প্রথম বুর্জ খলিফা দেখতে এসেছেন। দেশে কীভাবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পাঠান, জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, মেসের পাশেই দোকান আছে। সেখানে টাকা জমা দিলে বউয়ের মোবাইলে চলে যায়। এক মিনিটও সময় লাগে না। কোনো কাগজপত্রও দিতে হয় না। কষ্ট করে কোথাও যেতে হয় না, সময়ও কম লাগে। ইমরান হোসেনের বক্তব্যও একই রকম। তিনজনই স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন, যাতে রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ।
নিজের মোবাইল ব্যবহার করে দেশে টাকা পাঠানোর সুবিধা চালু হলে সেই সুযোগ নেবেন কি না, জিজ্ঞেস করলে, তিনজনই বলে উঠেন, ‘হ্যাঁ।’
হাতের কাছেই হুন্ডি
এই তিনজনের মতো আরব আমিরাতের দুবাই, শারজা ও আবুধাবিতে কর্মরত প্রায় ৩০ জন প্রবাসী শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা সবাই প্রথম আলোকে জানান, টাকা পাঠাতে আলাদা কোনো ছুটি পাওয়া যায় না। এ জন্য তাঁরা এক্সচেঞ্জ হাউসে গিয়ে দেশে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে পারেন না। বাসার পাশেই হুন্ডি করার সুযোগ আছে, এটাই সহজ পথ। আবার এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে পাঠালে যেখানে প্রতি দিরহামে পাওয়া যায় ২৯ টাকা ২০ পয়সা, সেখানে হুন্ডিতে মেলে ৩১ টাকার বেশি। দুই টাকা বেশি পেতে তাঁরা হুন্ডিতে টাকা পাঠান।
দুবাইয়ের ডেইরা, লেবার ক্যাম্প–সংলগ্ন মার্কেট ও সবজি বাজার, আবুধাবির আল আইন; শারজার রোলা; আজমানের সবজি বাজার ও লেবার ক্যাম্প প্রভৃতি এলাকায় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক থাকেন। প্রতিটি জায়গাতেই রয়েছে হুন্ডি করার ব্যবস্থা।
ইউএইতে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক ও খুদে ব্যবসায়ীরা মাসে এক থেকে দুই হাজার দিরহাম আয় করেন। যেমন চট্টগ্রামের হাটহাজারি থেকে যাওয়া সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ ইউসুফ প্রায় দুই হাজার, মহেশখালীর আলতাফ হোসেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করে ১ হাজার, বরিশালের শামীম আহমেদ ইলেকট্রনিক কোম্পানির কাজে ১ হাজার ১০০ দিরহাম পান। তাঁরা সবাই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠান। অবশ্য তাঁরা বলেন, ‘মোবাইল ফোনে পাঠাই’। ইউএই থেকে দেশে ফেরার পথে সৌদি আরবের রিয়াদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কথা হয় বাহরাইনে থাকা দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনিও একইভাবে আয় পাঠানোর কথা জানান।
হুন্ডির মাধ্যমে (প্রবাসীদের ভাষায় মোবাইল ফোনে) আসা অর্থ দেশে তাঁদের পরিবারের বিকাশ, রকেট ও নগদ—এসব মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) হিসাবে পাঠিয়ে দেয় হুন্ডি চক্রের এদেশীয় অংশীদারেরা।
সম্ভাবনা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে
ইউএইসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ পথে হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসছে। অবৈধ পথে মানে হুন্ডিতে প্রবাসী আয় আসা বন্ধ হলে দেশে ডলারের সরবরাহ বাড়বে এবং অর্থ পাচার কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ জন্য মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনার সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে গত ৩০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এখন থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এমএফএসগুলো প্রবাসী আয় প্রত্যাবাসনে (দেশে আনা) বিদেশের অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস প্রোভাইডার, ব্যাংক, ডিজিটাল ওয়ালেট, কার্ড স্কিম ও অ্যাগ্রিগেটর পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে পারবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী এমএফএসগুলো যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করবে, তাদের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা জমা হবে। এরপর তা প্রবাসীর এমএফএস হিসাবে টাকায় রূপান্তরিত হয়ে জমা হবে। বিদেশে কর্মরত প্রবাসীরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় এমএফএস হিসাব খুলে দেশে টাকা পাঠাতে পারবেন। দেশের ব্যাংকগুলো এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেটেলমেন্ট (নিষ্পত্তি) হিসাব সুবিধা দেয়। ব্যাংকের বিদেশি নস্ট্রো হিসাবে অর্থ জমা হওয়ার পর তার সমপরিমাণ টাকা সেটেলমেন্ট হিসাবে জমা হয়।
দেশে এখন এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও রকেট বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনছে। বিশ্বের ৯০টি দেশ থেকে ৮০টির বেশি মানি ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠানো যায়। ২০২২ সালে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আয় এসেছে বিকাশের মাধ্যমে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিকাশের করপোরেট কমিউনিকেশনস বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে প্রবাসীদের জন্য যে ‘ওয়েজ আর্নার্স অ্যাকাউন্ট’ খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা চালু হলে প্রবাসীরা নিজেদের এমএফএস হিসাবে আয় রেখে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে পারবেন। এতে আয়ের ওপর তাঁদের আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে প্রবাসীরা সরাসরি আয় পাঠাতে আরও বেশি উৎসাহী হবেন।’
রকেট সেবাদাতা ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবাসীদের পরিবার যাতে রকেট থেকে টাকা উত্তোলনে আগ্রহী হয়, এ জন্য বিনা মাশুলে রেমিট্যান্সের টাকা উত্তোলনের সুবিধা চালু করা হয়েছে। যেসব দেশ থেকে প্রবাসী আয় বেশি আসে, ওই দেশগুলোর বড় এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর অ্যাপসে রকেট–সুবিধা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে আশা করি, প্রবাসী আয় বাড়বে। তবে প্রবাসী শ্রমিকেরা অ্যাপস ব্যবহারে এখনো অনেক পিছিয়ে আছেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ভয়ও কাজ করছে।
সূত্র :প্রথম আলো