কৃষির উন্নয়ন, শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণে যাঁরা নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন, সেই কৃষিবিদরাই নানা কারণে দ্বিধাবিভক্ত, জড়িয়ে পড়েছেন রেষারেষিতে। প্রকাশ্যেই করছেন কাদা ছোড়াছুড়ি। তাঁদের দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে আদালত আঙিনায়। চলছে মামলা-পাল্টা মামলা। এমন পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ কৃষিবিদরা আছেন অস্বস্তিতে। কৃষির নানা দপ্তরে চলছে অস্থিরতা। খেই হারাচ্ছে কার্যক্রম। নেতাদের রেষারেষির কারণে কৃষিবিদরা তাঁদের মেধা ঠিকমতো মেলে ধরতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে পূরণ হচ্ছে না তাঁদের দাবি-দাওয়া।
কখনও ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) থেকে পাস করা কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব, আবার কখনও কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (কেআইবি) দুই গ্রুপের কোন্দলে কৃষি খাতে পড়ছে প্রভাব। দুই পক্ষের বিভাজন নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন কৃষিবিদরা।
এমন পটভূমিতে আজ সোমবার দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে কৃষিবিদ দিবস। ১৯৭৩ সালের এই দিনে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে ২০১১ সাল থেকে প্রতিবছর ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ দিবস পালন হয়ে আসছে। দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেআইবি প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। রাজধানীর কেআইবিতে আজ বিকেলে সংগঠনটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। একই দিনে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথি থাকবেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। অবশ্য ওই অনুষ্ঠানে সারাদেশের কৃষি কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার নির্দেশনা দিয়ে আলোচনার ঘূর্ণি বয়ে দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রতিবছরই কৃষিবিদ দিবস এলে আলাদা কর্মসূচির কারণে বিপত্তিতে পড়েন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কৃষিবিদরা।
কেআইবি ঘিরে দ্বন্দ্ব :১৯৮১ সালের ২০ জানুয়ারি কেআইবি প্রতিষ্ঠা হয়। রাজধানীর খামারবাড়ি এলাকায় সংগঠনের ভবনে আছে অত্যাধুনিক হল, কমিউনিটি সেন্টার, সুইমিংপুল, খেলাধুলা, ক্যাফেটেরিয়া, ডরমিটরিসহ নানা ব্যবস্থা। ৩৫ হাজার কৃষিবিদের এ সংগঠনে দীর্ঘদিন চলছে সংকট। দুই বছর মেয়াদি কমিটি সচল আছে ছয় বছর।
কেআইবির সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। এতে এএমএম সালেহ সভাপতি ও মো. খায়রুল আলম প্রিন্স মহাসচিব নির্বাচিত হন। এএমএম সালেহ ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মারা যাওয়ার পর সিনিয়র সহসভাপতি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন। ২০১৭-১৮ কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয় চার বছর আগে। ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর ২০১৯-২০ মেয়াদি কমিটির নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। তবে ভুয়া ভোটার অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ এনে ভোটের আগের রাতে কৃষিবিদ ড. আজিজুল ইসলামের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন স্থগিত করেন আদালত। বাহাউদ্দিন নাছিম মনোনীত দুটি এবং ড. আব্দুর রাজ্জাক ও আবদুল মান্নান মনোনীত দুটি পরিষদ ওই নির্বাচনে লড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। ওই সময় থেকেই কৃষিবিদদের দুই ধারা। তাঁদের কেউ বাকৃবি, আবার কেউ শেকৃবি ধারায় বিভক্ত।
গত ২৩ জুলাই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) মিলনায়তনে এক সেমিনারে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে তিন বছর ধরে লিডারশিপ নেই। ভঙ্গুর অবস্থা। কিছু মানুষ এটা দখল করে রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারেও ভালো অবস্থানে আছেন, ভালো পদে আছেন। তবে তাঁদের নেতৃত্ব দুর্বল।’ এর পর ২৬ জুলাই কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের পক্ষ থেকে মন্ত্রীর এই বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘২০১৮ সালে কেআইবির নির্বাচনের আগের রাতে কৃষিমন্ত্রীর ইন্ধনে একটি গ্রুপ মামলা করে নির্বাচন স্থগিত করায়। ওই গ্রুপ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও মামলা করে। ওই মামলার জের ধরে একটি পক্ষ একই বিষয়ে আরও একটি মামলা করে। মামলা চলমান থাকায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের নির্বাচন সম্ভব হচ্ছে না।’
২০১৯-২০ মেয়াদি কার্যনির্বাহী কমিটি নির্বাচন স্থগিত হওয়ার বছর দেড়েক পর ইমরান হোসেন খান নামে এক কৃষিবিদ কেআইবির নির্বাচন চেয়ে আদালতে যান। হাইকোর্ট বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির কার্যক্রম বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে গত ৩ নভেম্বর সমাজসেবা অধিদপ্তর কমিটি বাতিল করে অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হককে প্রশাসক নিয়োগের আদেশ জারি করে।
এরই মধ্যে কেআইবি সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া হাইকোর্টের আদেশের বিপক্ষে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। গত ৯ জানুয়ারি আপিল আবেদন খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। এর পর এখনও প্রশাসকের দায়িত্ব নেননি মোজাম্মেল হক।
তবে কেআইবির দপ্তর সম্পাদক মিজানুর রহমান দাবি করেন, প্রশাসক নিয়োগের সেই নির্দেশনায় আদালতের স্থগিতাদেশ আছে। তবে এ বিষয়ে তিনি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের ঢাকার বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক এখন ভারতে। গতকাল তাঁকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের পর আমাকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পর কেআইবির পক্ষ থেকে করা আপিল খারিজ হয়ে যায়। ভারতে থাকায় দায়িত্ব এখনও নিতে পারিনি। পরে প্রশাসক নিয়োগের আদেশ স্থগিতের বিষয়টি আমার জানা নেই। দেশে এসেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
দুই মেরুতে বাকৃবি-শেকৃবি :বাকৃবি ও শেকৃবি থেকে পাস করা কৃষির বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব এখন অনেকটা প্রকাশ্যে। রেষারেষি ছড়িয়ে পড়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরেও। কারণ, সেখানেও কর্মরত আছেন অনেক কৃষিবিদ। এই বিরোধের উত্তাপ মাঝেমধ্যে দপ্তর থেকে ছড়ায় বাইরেও। গত জুলাইয়ে শেকৃবির কিছু শিক্ষার্থী অনিয়ম বন্ধের দাবিতে রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে স্মারকলিপি দিতে যান। এ সময় কর্মকর্তাদের দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এরই জেরে গত ২ আগস্ট সে সময়ের মহাপরিচালক বেনজীর আলমের সভাপতিত্বে ডিএইর ব্যবস্থাপনা কমিটির ১০৯তম সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভার কার্যবিরণীতে বলা হয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্যদের ডিএইতে ঢোকার ক্ষেত্রে পাস লাগবে। বহিরাগতদের গাড়ি ও মোটরসাইকেল প্রবেশ বন্ধ। যে কোনো দপ্তরে কোনো কর্মচারী তিন বছর চাকরি করলে তাকে বদলি করতে হবে। বারবার একই উইংয়ে বদলি নিরুৎসাহিত করা হয়। এর পর থেকে খামারবাড়িতে প্রবেশে আরোপ করা হয় কড়াকড়ি। পেছনের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কৃষির অন্য দপ্তরেও দুই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কর্মকর্তাদের মধ্যে মনোমালিন্যে কার্যক্রমে ভাটা পড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কৃষিবিদরা এ দেশের কৃষির প্রাণভোমরা। অথচ তাঁদের মধ্যে চলছে বিভাজন। প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েলের চেষ্টা চলে। অনৈক্যের কারণে কৃষিবিদদের দাবি-দাওয়াও পূরণ হচ্ছে না। সবাইকে এক ছাতার নিচে আনতে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’
কেআইবির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও শেকৃবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া গত রাতে সমকালকে বলেন, কৃষিবিদদের দ্বন্দ্বে মাঠ পর্যায়ে প্রভাব পড়ছে। রেষারেষির কারণে কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষিবিদ দিবসে বাকৃবি শিক্ষকদের একটি সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকতে চিঠি দিয়েছে। এটা মন্ত্রণালয় করতে পারে না। এ ব্যাপারে শুভবুদ্ধির পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল। কৃষিবিদদের দ্বন্দ্বের বিষয়ে তিনি বলেন, যখন ওপর দিকে সমস্যা থাকে তখন ধারাবাহিক সমস্যা নিচের দিকেও তৈরি হয়। এ রকম আচরণ কাম্য নয়। নতুন প্রজন্মের মধ্যে যারা কৃষিতে নেতৃত্ব দেবে, তাদের এভাবে বিপদে ফেলা উচিত নয়। ড. শহীদুর রশীদ বলেন, পেশাগত কাজের মধ্যে পদোন্নতি কিংবা বদলিতে সমস্যা হয়- এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়। পেশাজীবীদের কল্যাণ ও দেশের উন্নতির জন্যই আমরা সংগঠন করি। খাদ্য উৎপাদন যেন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়, সেজন্য আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে।
দ্বন্দ্ব নিরসনে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, আমি চাই না কোনো মতভেদ থাকুক। কেআইবি নির্বাচন করতে হবে- এমন দ্বন্দ্বে গেলে এটাকে মেলানো কঠিন হবে। খোলা মন নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে সমস্যা দূর করা দরকার।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক গত রাতে সমকালকে বলেন, কেআইবির বর্তমান কমিটিকে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ অবৈধ ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশে আমি কখনও শুনিনি সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কেউ অম্যান্য করতে পারে। এটা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। তিনি বলেন, কৃষিবিদ দিবস প্রবর্তন আমরাই করেছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, স্বাধীনতার পর দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নির্বাচনে শুধু বাকৃবিতে ছাত্রলীগ জিতেছিল। আমি জিএস নির্বাচিত হই। তখন বঙ্গবন্ধু আমাদের ওপর খুশি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেন। সেই দিনকেই কৃষিবিদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কৃষিবিদদের দ্বন্দ্ব নিরসনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা একই দল করি। সব সময় মতভেদ দূর করতে চাই। তবে এর আগে তো নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। তখন দু’পক্ষ সমঝোতা করে একটা প্যানেল করা যাবে। তবে তারা নির্বাচন দিতে চায় না।
সূত্র :সমকাল