দাওয়াত ও তাবলিগের নীতি পদ্ধতির আলোচনায় মুখরিত হবে ১৪৪৪ হিজরির ১৭তম তারাবিহ। আজ সুরা নমলের ৬০ আয়াত থেকে (৯৩) শেষ পর্যন্ত, সুরা কাসাস, সুরা আনকাবুত-এর ৪৪ আয়াত পড়া হবে আজ। সৃষ্টিজগতের কর্তৃত্ব ও পৃথিবী সুসজ্জিত করার কারিগর মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরে শুরু হবে আজকের তারাবিহ। আল্লাহ তাআলা প্রশ্ন রেখে বলেন-
اَمَّنۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ اَنۡزَلَ لَکُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ مَآءً ۚ فَاَنۡۢبَتۡنَا بِهٖ حَدَآئِقَ ذَاتَ بَهۡجَۃٍ ۚ مَا کَانَ لَکُمۡ اَنۡ تُنۡۢبِتُوۡا شَجَرَهَا ؕ ءَ اِلٰهٌ مَّعَ اللّٰهِ ؕ بَلۡ هُمۡ قَوۡمٌ یَّعۡدِلُوۡنَ
বলুন তো কে সৃষ্টি করেছেন নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল? এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্য বর্ষণ করেছেন পানি; অতপর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি। তার বৃক্ষাদি উৎপন্ন করার শক্তিই তোমাদের নেই। অতএব, আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো উপাস্য আছে কি? বরং তারা (অবিশ্বাসীরা) সত্যবিচ্যুত সম্প্রদায়।’ (সুরা নমল : আয়াত ৬০)
হাফেজে কোরআনদের মনোমুগ্ধকর তেলাওয়াতে সম্পন্ন হবে ২০তম পারা। আজকের তারাবিহতে যা পড়া হবে তার সংক্ষিপ্ত আলোচ্যসূচি তুলে ধরা হলো-
সুরা নমল : (৬০-৯৩)
সুরা নমল মক্কায় অবতীর্ণ। নমল দ্বারা আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রাণী পিপীলিকাকে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা এ সুরায় পিপীলিকার কথা বর্ণনা করেছেন। তাই এ সুরার নাম দিয়েছেন নমল।
সৃষ্টিজগতের কর্তৃত্ব ও পৃথিবী সুসজ্জিত করার কারিগর মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরে শুরু হবে আজকের তারাবিহ। আল্লাহ তাআলা প্রশ্ন রেখে বলেন-
اَمَّنۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ اَنۡزَلَ لَکُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ مَآءً ۚ فَاَنۡۢبَتۡنَا بِهٖ حَدَآئِقَ ذَاتَ بَهۡجَۃٍ ۚ مَا کَانَ لَکُمۡ اَنۡ تُنۡۢبِتُوۡا شَجَرَهَا ؕ ءَ اِلٰهٌ مَّعَ اللّٰهِ ؕ بَلۡ هُمۡ قَوۡمٌ یَّعۡدِلُوۡنَ
‘বলুন তো কে সৃষ্টি করেছেন নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল? এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্য বর্ষণ করেছেন পানি; অতপর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি। তার বৃক্ষাদি উৎপন্ন করার শক্তিই তোমাদের নেই। অতএব, আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো উপাস্য আছে কি? বরং তারা (অবিশ্বাসীরা) সত্যবিচ্যুত সম্প্রদায়।’ (সুরা নমল : আয়াত ৬০)
সেই আল্লাহই সৃষ্টি, রুজি তথা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিতে একক; তাঁর কোনো শরিক নেই। বলছেন যে, আকাশকে এত উঁচু ও সুন্দর করে সৃষ্টিকারী ও চলমান গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টিকারী অনুরূপ পৃথিবী ও তার মাঝে পাহাড়, নদ-নদী, সমুদ্র, গাছ-পালা, ফল-ফসল, নানা প্রকারের পশু-পক্ষী সৃষ্টিকারী, আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে সুন্দর বাগান উৎপাদনকারী কে?
তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, কেবল পৃথিবী থেকে গাছ সৃষ্টি করতে পারে? এ সবের উত্তরে মুশরিকরাও বলত এবং স্বীকার করত যে, এ সব কিছুর কর্তা একমাত্র আল্লাহ। যেমন- এ কথা কোরআনের অন্য জায়গায়ও রয়েছে-
وَ لَئِنۡ سَاَلۡتَهُمۡ مَّنۡ نَّزَّلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَحۡیَا بِهِ الۡاَرۡضَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَوۡتِهَا لَیَقُوۡلُنَّ اللّٰهُ ؕ قُلِ الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ ؕ بَلۡ اَکۡثَرُهُمۡ لَا یَعۡقِلُوۡنَ
আর তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন কর, ‘কে আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দ্বারা যমীনকে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করেন’? তবে তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। বল, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর’। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বুঝে না।’ (সুরা আনকাবুত: আয়াত ৬৩)
এ সকল বাস্তবতার পরেও আল্লাহর সঙ্গে এমন কোন সত্তা আছে, যে ইবাদতের যোগ্য? বা কেউ উক্ত জিনিসগুলোর মধ্যে কোনো একটিকে সৃষ্টি করেছে? অর্থাৎ কেউ এমন নেই যে, সে কিছু সৃষ্টি করেছে বা ইবাদতের যোগ্য। এই সব আয়াতে أَمَّن এর অর্থ হল যে, সেই সত্তা যিনি ঐ সকল জিনিসের সৃষ্টিকর্তা, তিনি কি ওর মত, যে এর মধ্যে কোন জিনিস সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে না? (ইবনে কাসির)
পিপীলিকার ঘটনা নবুয়তে প্রমাণ
পিপীলিকার ঘটনা হজরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের নবুয়তের প্রমাণ বহন করে, আর এ ঘটনার বর্ণনা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের প্রমাণের গুরুত্ব সর্বাধিক। সুরা নমলে তাওহিদ ও নবুয়ত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সৃষ্টিজগতের পরিচালনায় মহান আল্লাহ চূড়ান্ত কৌশলী। তিনি তার সে সব রহস্যগুলো সুবিন্যস্ত করে বলেন-
اَمَّنۡ جَعَلَ الۡاَرۡضَ قَرَارًا وَّ جَعَلَ خِلٰلَهَاۤ اَنۡهٰرًا وَّ جَعَلَ لَهَا رَوَاسِیَ وَ جَعَلَ بَیۡنَ الۡبَحۡرَیۡنِ حَاجِزًا ؕ ءَ اِلٰهٌ مَّعَ اللّٰهِ ؕ بَلۡ اَکۡثَرُهُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ
‘বল তো কে পৃথিবীকে বাসোপযোগী করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ-নদী প্রবাহিত করেছেন এবং তাকে স্থিত রাখার জন্যে পর্বত স্থাপন করেছেন এবং দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন। অতএব, আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো উপাস্য আছে কি? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না।’ (সুরা নমল : ৬১)
মিঠা ও নোনা পানির ভাণ্ডার। এ ভাণ্ডার পৃথিবীতেই রয়েছে কিন্তু তারা কখনো পরস্পর মিশে যায় না। ভূ-গর্ভের পানির স্রোতও কখনো একই এলাকায় মিঠা পানির স্রোত আলাদা এবং নোনা পানির স্রোত আলাদা দেখা যায়। নোনা পানির সাগরেও দেখা যায় কোথাও মিঠা পানির স্রোত আলাদা প্রবাহিত হচ্ছে। (ইবনে কাসির, ফাতহুল কাদির)
পৃথিবী স্থির ও অটল। না নড়ে-চড়ে, আর না দোল খায়। যদি এ রকম না হত তাহলে পৃথিবীতে বসবাস করা অসম্ভব হত। পৃথিবীতে বিশাল বিশাল পাহাড় সৃষ্টি এই উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে, যাতে পৃথিবী নড়া-চড়া না করতে পারে। (আহসানুল বয়ান)
অসহায়ের আহ্বানে সাড়া
اَمَّنۡ یُّجِیۡبُ الۡمُضۡطَرَّ اِذَا دَعَاهُ وَ یَکۡشِفُ السُّوۡٓءَ وَ یَجۡعَلُکُمۡ خُلَفَآءَ الۡاَرۡضِ ؕ ءَ اِلٰهٌ مَّعَ اللّٰهِ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَذَکَّرُوۡنَ
‘বরং তিনি, যিনি নিরুপায়ের আহবানে সাড়া দেন এবং বিপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে যমীনের প্রতিনিধি বানান। আল্লাহর সাথে কি অন্য কোন ইলাহ আছে ? তোমরা কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাক।’ (সুরা নমল: আয়াত ৬২)
مضطر শব্দটি اضطرار থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ, কোন অভাব হেতু অপারগ ও অস্থির হওয়া। এটা তখনই হয়, যখন কোন হিতকামী, সাহায্যকারী ও সহায় না থাকে। কাজেই এমন ব্যক্তিকে مضطر বলা হয়, যে দুনিয়ার সব সহায় থেকে নিরাশ হয়ে একান্তভাবে আল্লাহ তাআলাকেই সাহায্যকারী মনে করে এবং তাঁর প্রতি মনোযোগী হয়। (ফাতহুল কাদির)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রকম পরিস্থিতিতে যে দোয়া করতে বলেছেন তাহলো-
اللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو فَلَا تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ، وَأَصْلِحْ لِي شَأْنِي كُلَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা রাহমাতাকা আরঝু ফালা তাকিলনি ইলা নাফসি ত্বরফাতা আইনিন, ওয়া আসলিহ লি শানি কুল্লুহু লা ইলাহা ইল্লা আংতা।’
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার রহমতের আশা করি। অতএব মুহুর্তের জন্যও আমাকে আমার নিজের কাছে সমৰ্পণ করবেন না। আর আপনি আমার সবকিছু ঠিক-ঠাক করে দিন। আপনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই।’ (আবু দাউদ ৫০৯০, মুসনাদে আহমাদ ৫/৪২)
অসহায়ের দোআ কবুল হওয়ার মূল কারণ হলো, আন্তরিকতা। কারণ, দুনিয়ার সব সহায় থেকে নিরাশ এবং সম্পর্কাদি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু আল্লাহ তাআলাকেই কার্যোদ্বারকারী মনে করে দোয়া করার মাধ্যমে ইখলাস প্রকাশ পায়। আল্লাহ তাআলার কাছে ইখলাসের মর্তবা ও মর্যাদাই আলাদা। মুমিন, কাফের, পরহেযগার ও পাপিষ্ঠ নির্বিশেষে যার কাছ থেকেই ইখলাস পাওয়া যায় তার প্রতিই দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলার করুণা হয়। (ফাতহুল কাদির)
যেমন- কোনো কোনো আয়াতেও এসেছে যে-
هُوَ الَّذِیۡ یُسَیِّرُکُمۡ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ ؕ حَتّٰۤی اِذَا کُنۡتُمۡ فِی الۡفُلۡکِ ۚ وَ جَرَیۡنَ بِهِمۡ بِرِیۡحٍ طَیِّبَۃٍ وَّ فَرِحُوۡا بِهَا جَآءَتۡهَا رِیۡحٌ عَاصِفٌ وَّ جَآءَهُمُ الۡمَوۡجُ مِنۡ کُلِّ مَکَانٍ وَّ ظَنُّوۡۤا اَنَّهُمۡ اُحِیۡطَ بِهِمۡ ۙ دَعَوُا اللّٰهَ مُخۡلِصِیۡنَ لَهُ الدِّیۡنَ ۬ۚ لَئِنۡ اَنۡجَیۡتَنَا مِنۡ هٰذِهٖ لَنَکُوۡنَنَّ مِنَ الشّٰکِرِیۡنَ فَلَمَّاۤ اَنۡجٰهُمۡ اِذَا هُمۡ یَبۡغُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ ؕ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنَّمَا بَغۡیُکُمۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ ۙ مَّتَاعَ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۫ ثُمَّ اِلَیۡنَا مَرۡجِعُکُمۡ فَنُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ
‘তিনিই তোমাদের জলে-স্থলে ভ্রমণ করান। এমনকি তোমরা যখন নৌযানে আরোহন কর এবং সেগুলো আরোহী নিয়ে অনুকূল বাতাসে বেরিয়ে যায় এবং তারা তাতে আনন্দিত হয়, তারপর যখন দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে এবং চারদিক থেকে উত্তাল তরঙ্গমালা ধেয়ে আসে, আর তারা নিশ্চিত ধারণা করে যে, এবার তারা ঘেরাও হয়ে পড়েছে, তখন তারা আল্লাহকে তাঁর জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে ডেকে বলেঃ ‘আপনি আমাদেরকে এ থেকে বাঁচালে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব। অতঃপর তিনি যখন তাদেরকে বিপদমুক্ত করেন তখন তারা যমীনে অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন করতে থাকে। হে মানুষ! তোমাদের সীমালঙ্ঘন তোমাদের বিরুদ্ধেই, এ সব কিছু দুনিয়ার ভোগ। অতঃপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। সুতরাং তখন আমি তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জানাব।’ [সুরা ইউনুস: আয়াত ২২-২৩)
আরও এসেছে-
فَاِذَا رَکِبُوۡا فِی الۡفُلۡکِ دَعَوُا اللّٰهَ مُخۡلِصِیۡنَ لَهُ الدِّیۡنَ ۬ۚ فَلَمَّا نَجّٰهُمۡ اِلَی الۡبَرِّ اِذَا هُمۡ یُشۡرِکُوۡنَ
‘তারা যখন নৌযানে আরোহণ করে তখন তারা আনুগত্যে বিশুদ্ধ হয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। তারপর তিনি যখন স্থলে ভিড়িয়ে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখন তারা শিরকে লিপ্ত হয়।’ (সুরা আল-আনকাবুত: আয়াত ৬৫)
অনুরূপভাবে বিভিন্ন হাদিসে যাদের দোয়া কবুল হয় বলে ঘোষণা এসেছে সেটার গুঢ় রহস্যও এ ইখলাসে নিহিত। যেমন- উৎপীড়িতের দোয়া, মুসাফিরের দোয়া। অনুরূপভাবে সন্তানের জন্য দোয়া বা বদ-দোয়া। এসব ঐ সময়ই হয় যখন তাদের আর করার কিছু থাকে না। তারা একান্তভাবেই আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। তখনকার অবস্থা অনুযায়ী আল্লাহ তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেন। যদিও তিনি জানেন যে, তারা অচিরেই শিরকের দিকে ফিরে যাবে। (কুরতুবি, ফাতহুল কাদির)
اَمَّنۡ یَّهۡدِیۡکُمۡ فِیۡ ظُلُمٰتِ الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ وَ مَنۡ یُّرۡسِلُ الرِّیٰحَ بُشۡرًۢا بَیۡنَ یَدَیۡ رَحۡمَتِهٖ ؕ ءَ اِلٰهٌ مَّعَ اللّٰهِ ؕ تَعٰلَی اللّٰهُ عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ
‘বরং তিনি, যিনি তোমাদের স্থলে ও সমুদ্রের অন্ধকারে পথ দেখান এবং যিনি স্বীয় রহমতের প্রাক্কালে সুসংবাদবাহী বাতাস প্রেরণ করেন। আল্লাহর সঙ্গে কি অন্য কোনো ইলাহ আছে? তারা যা কিছু শরিক করে আল্লাহ তা থেকে ঊর্ধ্বে।’ (সুরা নমল : আয়াত ৬৩)
যেমন অন্য আয়াতে বলেছেন, ‘আর তিনিই তোমাদের জন্য তারকামণ্ডল সৃষ্টি করেছেন যেন তা দ্বারা তোমরা স্থলের ও সাগরের অন্ধকারে পথ খুঁজে পাও।’ (সুরা আল-আনআম: আয়াত ৯৭)
যিনি তারকার সাহায্যে এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যার ফলে তোমরা রাতের অন্ধকারেও নিজেদের পথের সন্ধান করতে পারো। মানুষ জলে-স্থলে যেসব সফর করে, সেখানে তাকে পথ দেখাবার জন্য আল্লাহ এমন সব উপায়-উপকরণ সৃষ্টি করেছেন যাতে সে সহজেই পথ চিনে নিতে পারে। (ইবনে কাসির; ফাতহুল কাদির) এ সবই আল্লাহর জ্ঞানগর্ভ ব্যবস্থাপনারই একটি অংশ। অন্যত্র এসবগুলোকে আল্লাহর অনুগ্রহের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে।
সৃষ্টিকর্তা কে?
اَمَّنۡ یَّبۡدَؤُا الۡخَلۡقَ ثُمَّ یُعِیۡدُهٗ وَ مَنۡ یَّرۡزُقُکُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ ءَ اِلٰهٌ مَّعَ اللّٰهِ ؕ قُلۡ هَاتُوۡا بُرۡهَانَکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ
‘বল তো কে প্রথমবার সৃষ্টি করেন, অতপর তাকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন এবং কে তোমাদেরকে আকাশ ও জমিন থেকে রিজিক দান করেন। সুতরাং আল্লাহর সাথে অন্য কোনো উপাস্য আছে কি? বলুন, তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত কর।’ (সুরা নমল : আয়াত ৬৪)
যিনি মাতৃগর্ভে শুক্রের মাধ্যমে সৃষ্টির সূচনা করেন (জালালাইন)। তারপর তাদের মৃত্যুর পর পুনরায় তাদেরকে উত্থিত করবেন, তার সঙ্গে কি আর কোনো শরিক আছে? এ কাজ কি তিনি ছাড়া আর কেউ করতে পারে? তাহলে তিনি ছাড়া অন্যরা কিভাবে ইবাদাত পেতে পারে? যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন-
اِنَّهٗ هُوَ یُبۡدِئُ وَ یُعِیۡدُ
‘নিশ্চয় তিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন, আর তিনিই তার পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন।’ (সুরা আল-বুরূজ: আয়াত ১৩)
এ পৃথিবীতে পশু প্রাণীর বহু শ্রেণী পাওয়া যায়। তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা খাদ্যের প্রয়োজন। স্রষ্টা তাদের প্রত্যেক শ্রেণীর খাদ্যবস্তু এত বিপুল পরিমাণে এবং প্ৰত্যেকের আহরণ ক্ষমতার এত কাছাকাছি রেখে দিয়েছেন, যার ফলে কোনো শ্রেণীর কোনো একজনও খাদ্য থেকে বঞ্চিত থাকে না। তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি নাজিল করেন, এর দ্বারা জমিন থেকে উদ্ভিদ উদগত করেন, যা জমিনের বরকত হিসেবে গণ্য। তিনি আকাশ থেকে যে পানি নাজিল করেন তা তিনি জমিনের অভ্যন্তরে সুচারুরূপে পরিচালিত করেন, তারপর তা থেকে বের করেন হরেক রকম ক্ষেত-খামার, ফল- ফলাদি ও ফুল ইত্যাদি। এসব তো আল্লাহর কাজ। তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ কি এগুলো করতে পারেন? যদি আর কেউ করতে না পারে তবে তাকে কীভাবে ইবাদাত করা হবে? (ইবনে কাসির)
সব বাতিল ইলাহ ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদাতই শুধু কর। তা না করলে তোমরা কখনো সফলকাম হতে পারবে না। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অন্য ইলাহকে ডাকে, এ বিষয়ে তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই; তার হিসাব তো তার রব-এর কাছেই আছে; নিশ্চয়ই কাফেররা সফলকাম হবে না।’ (সুরা আল-মুমিনুন: আয়াত ১১৭)
আল্লাহ তাআলা অবিশ্বাসীদেরকে মৃতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ মর্মে আয়াত নাজিল করে বলেন-
فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰهِ ؕ اِنَّکَ عَلَی الۡحَقِّ الۡمُبِیۡنِ اِنَّکَ لَا تُسۡمِعُ الۡمَوۡتٰی وَ لَا تُسۡمِعُ الصُّمَّ الدُّعَآءَ اِذَا وَلَّوۡا مُدۡبِرِیۡنَ
‘অতএব, আপনি আল্লাহর উপর ভরসা করুন। নিশ্চয় আপনি সত্য ও স্পষ্ট পথে আছেন। আপনি আহবান শোনাতে পারবেন না মৃতদেরকে এবং বধিরকেও নয়, যখন তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে যায় ।’ (সুরা নমল: আয়াত ৭৯-৮০)
তুমি তোমার সমস্ত ব্যাপার তাঁকে সোপর্দ কর ও তাঁরই উপর ভরসা কর। তিনিই তোমার সাহায্যকারী। প্রথমত এই জন্য যে, তুমি সত্য দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর দ্বিতীয় কারণ আগে আসছে।
মৃতরা কি কিছু শুনতে পায়? আর মৃতদের কি কিছু শোনানো সম্ভব? যে সমস্ত বিষয়ে সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের মাঝেও মতপার্থক্য ছিল মৃতদের শ্রবণ করার বিষয়টি সেগুলোর অন্যতম।’ (মাজমূ’ ফাতাওয়া ৩/২৩০, ১৯/১২৩; আল-মুস্তাদরাক আলা মাজময়িল ফাতাওয়া ১/৯৪)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা পক্ষে এবং হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বিপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন।’ (বুখারি ৩৯৮০, ৩৯৮১; মুসলিম ৯৩২)
তাই তাবেয়ীগণ এবং এর পরবর্তী আলেমগণ সবাই ভিন্ন দুটি মতে বিভক্ত হয়েছেন। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে যা এসেছে এখানে তা বর্ণনা করছি। আলোচ্য সুরা আন-নামলের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মৃতকে তো আপনি শোনাতে পারবেন না।’
সুরা আর-রূমে বলা হয়েছে, ‘আপনি তো মৃতকে শুনাতে পারবেন না।’ (সুরা আর-রূম: আয়াত ৫২)
অনুরূপভাবে সুরা ফাতিরে এসেছে, ‘আপনি শোনাতে পারবেন না যারা কবরে রয়েছে তাদেরকে।’ (সুরা ফাতির: আয়াত ২২)
এতে বুঝা যায় যে, মৃতদের শোনানোর দায়িত্ব মানুষের নয়, এটা আল্লাহর কাজ। তাই সর্বাবস্থায় মৃতরা শুনতে পাবে এটার সপক্ষে কোনো দলিল নেই। তবে আল্লাহর ইচ্ছায় মাঝে মধ্যে তারা যে শুনতে পায় তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি এক হাদিসে-
বদরের যুদ্ধের পরে কাফেরদের লাশ যখন একটি গর্তে রেখে দেওয়া হলো, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের লাশদের উদ্দেশ্য করে নাম ধরে ডেকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা কি তোমাদের মাবুদদের কৃত ওয়াদাকে বাস্তব পেয়েছ? আমরা তো আমাদের মাবুদের ওয়াদা বাস্তব পেয়েছি। সাহাবিগণ বললেন, রাসুল! আপনি এমন লোকদের সঙ্গে কি কথা বলছেন যারা মরে পচে গেছে? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! তোমরা আমার কথা তাদের থেকে বেশি শুনতে পাচ্ছো না।’ (বুখারি ৩৭৫৭) সুতরাং কবর যেহেতু আখেরাতের ব্যাপার আর আখেরাতের ব্যাপারে যতটুকু কোরআন ও হাদিসে যা এসেছে তার বাইরে কোনো কিছু বলা কোন ক্রমেই ঠিক নয়। (কুরতুবি; ফাতহুল কাদির)
আল্লাহ তাআলা যাদেরকে সত্য দেখা থেকে অন্ধ বানিয়েছেন। তুমি তাদেরকে কীভাবে তাদের লক্ষ্যে; অর্থাৎ ঈমান পর্যন্ত পৌঁছাতে পার? আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ مَاۤ اَنۡتَ بِهٰدِی الۡعُمۡیِ عَنۡ ضَلٰلَتِهِمۡ ؕ اِنۡ تُسۡمِعُ اِلَّا مَنۡ یُّؤۡمِنُ بِاٰیٰتِنَا فَهُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ
‘আপনি অন্ধদেরকে তাদের পথভ্রষ্টতা থেকে ফিরিয়ে সৎপথে আনতে পারবেন না। আপনি কেবল তাদেরকে শোনাতে পারবেন, যারা আমার আয়াতসমূহে বিশ্বাস করে। অতএব, তারাই আজ্ঞাবহ।’ (সুরা নমল : আয়াত ৮১)
একত্ববাদের ঘোষণা
তাওহিদের বর্ণনায় শেষ হবে সুরা নমল। যেখানে আল্লাহ তাআলা সৎকর্মশীল বান্দার সতর্ককারী হিসেবে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছেন। আর যারা কুরআনের উপদেশ গ্রহণ করবে না, নবির সতর্কতা মানবে তারাই মুর্খ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ اَنۡ اَتۡلُوَا الۡقُرۡاٰنَ ۚ فَمَنِ اهۡتَدٰی فَاِنَّمَا یَهۡتَدِیۡ لِنَفۡسِهٖ ۚ وَ مَنۡ ضَلَّ فَقُلۡ اِنَّمَاۤ اَنَا مِنَ الۡمُنۡذِرِیۡنَ وَ قُلِ الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ سَیُرِیۡکُمۡ اٰیٰتِهٖ فَتَعۡرِفُوۡنَهَا ؕ وَ مَا رَبُّکَ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ
‘এবং যেন আমি কোরআন পাঠ করে শোনাই। পর যে ব্যক্তি সৎপথে চলে, সে নিজের কল্যাণার্থেই সৎপথে চলে এবং কেউ পথভ্রষ্ট হলে আপনি বলে দিন, আমি তো কেবল একজন ভীতি প্রদর্শনকারী। আর আরও বলুন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। সত্বরই তিনি তাঁর নিদর্শনসমূহ তোমাদেরকে দেখাবেন। তখন তোমরা তা চিনতে পারবে। আর তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে আপনার পালনকর্তা গাফেল নন।’ (সুরা নমল : আয়াত ৯২-৯৩)
আমার কাজ শুধু পৌঁছে দেওয়া। আমার দাওয়াত ও তবলীগে যারা মুসলমান হবে, উপকার তাদেরই হবে। কারণ, তারা আল্লাহর শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। আর যারা আমার দাওয়াত গ্রহণ করবে না, এতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। মহান আল্লাহ নিজে তাদের হিসাব নেবেন ও জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করাবেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুটি কাজের নির্দেশ বিশেষভাবে প্রদান করা হয়েছে। এক. তাওহিদ তথা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদাত করতে। দুই. কোরআন তেলাওয়াত করতে। মানুষকে এ তেলাওয়াত শোনাতে ও তাদের কাছে পয়গাম পৌছাতে। অর্থাৎ তিনি তো শুধু প্রচারকারী ও ভীতিপ্রদর্শনকারী। তারপর যদি কেউ হেদায়াত গ্ৰহণ করে তবে সেটা তার নিজেরই উপকারার্থে, আর যদি পথভ্রষ্ট হয়, তবে সেটার ভারও তার নিজের উপর। রাসুলের উপর এর দায়-দায়িত্ব বর্তবে না। তাই রাসুলকে বলতে বলা হয়েছে যে, যদি কেউ পথভ্রষ্ট হয়, তবে আমি তো কেবল অন্যান্য নবি-রাসুলদের মত ভীতি প্রদর্শন করতে পারি। তারা যেভাবে তাদের সম্প্রদায়কে ভীতি প্রদর্শন করেই তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন, সেভাবে আমিও তাদের অনুসরণ করব। তারপর সে সমস্ত সম্প্রদায়ের হিসাবের দায়িত্ব আল্লাহরই উপর। (ইবনে কাসির)
এজন্যই আল্লাহর প্রশংসা যে, তিনি কারও বিপক্ষে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত না করে শাস্তি দেন না। অনুরূপভাবে কাউকে ওজর পেশ করার সুযোগ শেষ করা পর্যন্ত আজাব নাজিল করেন না। আর সে জন্যই তিনি তাঁর আয়াতসমূহ নাজিল করবেন। যাতে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে বলতে না পারে যে, আমাদের কাছে আয়াত এলে তো আমরা ঈমান আনতাম।’ (ইবনে কাসির)
সুরা কাসাস : (০১-৮৮)
মক্কায় অবতীর্ণ সুরাসমূহের মধ্যে সুরা কাসাস হলো সর্বশেষ সুরা। হিজরতের সময় মক্কা এবং জুহফার মধ্যবর্তী স্থান রাবেগ-এ সুরাটি নাজিল হয়। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে-
‘হিজরতের সময় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জুহফা অর্থাৎ রাবেগ অঞ্চলে পৌছেন, তখন জিবরিল আলাইহিস সালাম এসে তাঁকে বলেন- ‘হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার কি মাতৃভূমির কথা মনে পড়ে? তিনি উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ’, মনে পড়বে বৈ কি। এরপর জিবরিল আলাইহিস সালাম তাকে এ সুরাটি শুনান। এ সুরার শেষাংশে মক্কা বিজয়ের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
সুরা কাসাসেও হজরত মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণের পাশাপাশি বিপুল সম্পদের মালিক কারুনের কথাও আলোচিত হয়েছে। মুসা আলাইহিস সালামের দেশত্যাগ, দুশমনের আক্রমণ থেকে রক্ষা, তার সম্মান-মর্যাদা রক্ষা, পুনরায় মিসর প্রত্যাবর্তন এবং নবুয়ত ও রিসালাত প্রদাণে ধন্য করেছেন তার বিবরণ ওঠে এসেছে এ সুরায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
تِلۡکَ اٰیٰتُ الۡکِتٰبِ الۡمُبِیۡنِ نَتۡلُوۡا عَلَیۡکَ مِنۡ نَّبَاِ مُوۡسٰی وَ فِرۡعَوۡنَ بِالۡحَقِّ لِقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ
‘এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত। আমি আপনার কাছে মুসা ও ফেরাউনের বৃত্তান্ত সত্যসহ বর্ণনা করছি, ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্যে।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ২-৩)
হেদায়েত আল্লাহর হাতে, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন
পূর্ববর্তী সুরা নমলের প্রথমাংশে বর্ণিত হয়েছে রাণী বিলকিসের আলোচনা। আর এ সুরায় মুসা ও ফেরাউনের বিষয়ে আলোচিত হয়েছে। তবে সুরা নমল ও সুরা কাসাসের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। রাণী বিলকিস হজরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের মুজেজা দেখে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল। কিন্তু ফেরাউন মুসা আলাইহিস সালামের মুজেজা দেখেও তাঁর প্রতি ঈমান আনেনি। অথচ ফেরাউনের রাজত্ব ছিল রাণী বিলকিসের রাজত্ব থেকে অনেক ছোট।
সুতরাং এ দুটি সুরা থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, হেদায়েত সবার জন্য নয়। হেদায়েত ও পথভ্রষ্টতা মহান আল্লাহরই হাতে। সে আলোকে হেদায়েত লাভ মহান আল্লাহর অনেক বড় অনুগ্রহ। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দান করতে পারেন। আবার যাকে ইচ্ছা গোমরাহ করতে পারেন। সুরা কাসাসের সংক্ষিপ্ত আলোচ্যসূচি তুলে ধরা হলো-
> হজরত মুসা আলাইহিস সালামের লাঠির বিবরণ; > হজরত মুসা আলাইহিস সালামের নবুয়ত লাভ; > বিশ্বনবির নবুয়তের প্রমাণ পেশ; > দাওয়াত ও তাবলীগের কতিপয় নীতি; > এক বস্তুর ওপর অপর বস্তু, এক ব্যক্তির ওপর অপর ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব দানের মাপকাঠি প্রসঙ্গ; > কারুনের প্রোথিত সম্পদের বিবরণ; > গোনাহের সংকল্পও গোনাহ; > কুরআন শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় ও উদ্দেশ্য হাসিলের উপায়।
আল্লাহ অনেক মহান। মুসা আলাইহিস সালাম জন্মের পর তার মা ফেরাউনের ভয়ে ছিলেন। কখন ফেরাউনের সৈন্যবাহিনী খবর পেয়ে তাকে নিয়ে যায়। মহান আল্লাহ ফেরাউনের ঘরেই মুসা আলাইহিস সালামকে তার মায়ের বুকের দধু খাইয়ে লালন পালনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সে সময় আল্লাহ তার মাকে এ মর্মে নির্দেশ দেন-
وَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰۤی اُمِّ مُوۡسٰۤی اَنۡ اَرۡضِعِیۡهِ ۚ فَاِذَا خِفۡتِ عَلَیۡهِ فَاَلۡقِیۡهِ فِی الۡیَمِّ وَ لَا تَخَافِیۡ وَ لَا تَحۡزَنِیۡ ۚ اِنَّا رَآدُّوۡهُ اِلَیۡکِ وَ جَاعِلُوۡهُ مِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ
‘আমি মুসা-জননীকে আদেশ পাঠালাম যে, তাকে দুধ পান করাতে থাক। এরপর যখন তুমি তার সম্পর্কে বিপদের আশংকা কর, তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ কর এবং ভয় করো না, দুঃখও করো না। আমি অবশ্যই তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে পয়গম্বরগণের একজন করব।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ৭)
এখানে ‘অহি’ বলতে অন্তরে কোনো কথার উদ্রেক করা, অন্তরে ইঙ্গিতে নির্দেশ দেওয়া বা প্রক্ষিপ্ত করা। ‘অহি’ বলতে সেই অহি বুঝানো হয়নি, যা জিবরিল ফেরেশতা দ্বারা নবি-রাসুলদের কাছে অবতীর্ণ হয়। আর যদি ফেরেশতা দ্বারা উক্ত অহি এসেও থাকে তবুও একটি অহি দ্বারা মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের নবি হওয়ার কথা সাব্যস্ত হয় না। কারণ, কখনো কখনো ফেরেশতাদের আগমন সাধারণ মানুষের কাছেও ঘটে থাকে। যেমন- হাদিসে টাক-ওয়ালা, অন্ধ ও কুষ্ঠরোগীর কাছে ফেরেশতাদের আগমন ও কথাবার্তা প্রমাণিত।’ (বুখারী, মুসলিম)
নদীতে ডুবে অথবা মরে যাওয়ার ভয় করবে না। আর তার বিরহে দুঃখও করবে না। এমনভাবে যে, তার পরিত্রাণ সুনিশ্চিত। কথিত আছে যে, সন্তান হত্যার এই ধারা যখন অনেক লম্বা হয়ে গেল, তখন ফেরাউন জাতির এই আশংকা বোধ হল, যদি এভাবে বনি ইসরাইল জাতিই নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে শ্রমসাধ্য কঠিন কাজগুলো আমাদেরই করতে হবে। এই আশংকার কথা তারা ফেরাউনের কাছে ব্যক্ত করলে সে এক নতুন আইন জারী করল যে, এক বছর নবজাত সন্তান হত্যা করা হোক আর এক বছর বাদ দেওয়া হোক। যে বছর সন্তান হত্যা না করার কথা সে বছর হারুন আলাইহিস সালামের জন্ম হয়। কিন্তু মুসা আলাইহিস সালামের জন্ম হয় হত্যার বছরে। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর পরিত্রাণের ব্যবস্থা এইভাবে করলেন যে-
প্রথমত: মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের গর্ভাবস্থার লক্ষণ এমনভাবে প্রকাশ করলেন না, যাতে ফেরাউনের ছেড়ে রাখা ধাত্রীদের চোখে পড়ে। সেই জন্য গর্ভের এই মাসগুলি নিশ্চিন্তে পার হয়ে গেল এবং এই ঘটনা সরকারের পরিবার পরিকল্পনার দায়িত্বশীলদেরও জানা হল না। কিন্তু জন্মের পর তাঁকে হত্যা করার আশংকা বিদ্যমান ছিল। যার সমাধান মহান আল্লাহ নিজেই ইলহামের মাধ্যমে মুসা আলাইহিস সালামের মাকে বুঝিয়ে দিলেন। এরপর তিনি তাঁকে একটি কফিনে (কাঠের বাক্সে) পুরে নীল নদে ভাসিয়ে দিলেন। (ইবনে কাসির)
فَالۡتَقَطَهٗۤ اٰلُ فِرۡعَوۡنَ لِیَکُوۡنَ لَهُمۡ عَدُوًّا وَّ حَزَنًا ؕ اِنَّ فِرۡعَوۡنَ وَ هَامٰنَ وَ جُنُوۡدَهُمَا کَانُوۡا خٰطِئِیۡنَ وَ قَالَتِ امۡرَاَتُ فِرۡعَوۡنَ قُرَّتُ عَیۡنٍ لِّیۡ وَ لَکَ ؕ لَا تَقۡتُلُوۡهُ ٭ۖ عَسٰۤی اَنۡ یَّنۡفَعَنَاۤ اَوۡ نَتَّخِذَهٗ وَلَدًا وَّ هُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ
‘এরপর ফেরাউন পরিবার মুসাকে কুড়িয়ে নিল, যাতে তিনি তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হয়ে যান। নিশ্চয়ই ফেরাউন, হামান, ও তাদের সৈন্যবাহিনী অপরাধী ছিল। ফেরাউনের স্ত্রী বলল, এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি, তাকে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি। প্রকৃতপক্ষে পরিণাম সম্পর্কে তাদের কোনো খবর ছিল না।’ (সুরা কাসাস: আয়াত ৮-৯)
وَ اَصۡبَحَ فُؤَادُ اُمِّ مُوۡسٰی فٰرِغًا ؕ اِنۡ کَادَتۡ لَتُبۡدِیۡ بِهٖ لَوۡ لَاۤ اَنۡ رَّبَطۡنَا عَلٰی قَلۡبِهَا لِتَکُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ قَالَتۡ لِاُخۡتِهٖ قُصِّیۡهِ ۫ فَبَصُرَتۡ بِهٖ عَنۡ جُنُبٍ وَّ هُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ
‘সকালে মুসা জননীর অন্তর অস্থির হয়ে পড়ল। যদি আমি তাঁর হৃদয়কে দৃঢ় করে না দিতাম, তবে তিনি মুসাজনিত অস্থিরতা প্রকাশ করেই দিতেন। দৃঢ় করলাম, যাতে তিনি থাকেন বিশ্ববাসীগণের মধ্যে। তিনি মুসার বোনকে বললেন, তার পেছন পেছন যাও। সে তাদের অজ্ঞাতসারে অপরিচিতা হয়ে তাকে দেখে যেতে লাগল।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১০-১১)
মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের অন্তর প্রত্যেক বস্তুর চিন্তা হতে খালি হয়ে গিয়ে শুধুমাত্র মুসার চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছিল। যাকে অস্থির বা ব্যাকুল হওয়া বলা যেতে পারে। দুঃখের কারণে এ কথা প্রকাশ করে দিতেন যে, এ শিশু আমার। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর অন্তরকে সুদৃঢ় রাখলেন। সুতরাং তিনি ধৈর্যধারণ করলেন আর বিশ্বাস রাখলেন যে, আল্লাহ মুসাকে সকুশল ফিরিয়ে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা অবশ্যই পূর্ণ হবে।
মুসা আলাইহিস সালামের বোনের নাম ছিল মারয়্যাম বিন্তে ইমরান। যেমন, ঈসার মাতার নামও ছিল মারয়্যাম বিন্তে ইমরান। উভয়ের নামে ও পিতার নামে ছিল অভিন্নতা। অতএব তিনি নদীর ধারে ধারে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলেন। পরিশেষে তিনি দেখতে পেলেন যে, তাঁর ভাই ফেরাউনের প্রাসাদে পৌঁছে গেল।
وَ حَرَّمۡنَا عَلَیۡهِ الۡمَرَاضِعَ مِنۡ قَبۡلُ فَقَالَتۡ هَلۡ اَدُلُّکُمۡ عَلٰۤی اَهۡلِ بَیۡتٍ یَّکۡفُلُوۡنَهٗ لَکُمۡ وَ هُمۡ لَهٗ نٰصِحُوۡنَ فَرَدَدۡنٰهُ اِلٰۤی اُمِّهٖ کَیۡ تَقَرَّ عَیۡنُهَا وَ لَا تَحۡزَنَ وَ لِتَعۡلَمَ اَنَّ وَعۡدَ اللّٰهِ حَقٌّ وَّ لٰکِنَّ اَکۡثَرَهُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ وَ لَمَّا بَلَغَ اَشُدَّهٗ وَ اسۡتَوٰۤی اٰتَیۡنٰهُ حُکۡمًا وَّ عِلۡمًا ؕ وَ کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ
‘আগে থেকেই আমি ধাত্রীদের মুসা থেকে বিরত রেখেছিলাম। মুসার বোন বলল, আমি তোমাদেরকে এমন এক পরিবারের কথা বলব কি, যারা তোমাদের জন্যে একে লালন-পালন করবে এবং তারা হবে তার হিতাকাঙ্ক্ষী? এরপর আমি তাকে জননীর কাছে ফিরিয়ে দিলাম, যাতে তার চক্ষু জুড়ায় এবং তিনি দুঃখ না করেন এবং যাতে তিনি জানেন যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য, কিন্তু অনেক মানুষ তা জানে না। যখন মূসা যৌবনে পদার্পন করলেন এবং পরিণত বয়স্ক হয়ে গেলেন, তখন আমি তাঁকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞানদান করলাম। এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১২-১৪)
আমি আমার কুদরতে ও সৃষ্টিগত নির্দেশে মুসাকে তাঁর মাতা ছাড়া অন্য সব ধাত্রীর দুধ পান করা নিষেধ করেছিলাম। সুতরাং বহু চেষ্টা-চরিত্র করার পর কোন ধাত্রী তাঁকে দুধ পান করাতে ও চুপ করাতে সফল হল না। এ সকল দৃশ্য তাঁর বোন চুপি চুপি প্রত্যক্ষ করছিলেন। পরিশেষে বলে ফেললেন যে, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি পরিবারের কথা বলব, যারা এই শিশুর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করবে?’
অতঃপর তারা মুসার বোনকে বলল, ‘যাও! সেই নারীকে ডেকে আনো।’ সুতরাং তিনি দ্রুত গিয়ে নিজ মা (যিনি মুসারও মা ছিলেন তাঁকে) ডেকে নিয়ে এলেন।
মুসা আলাইহিস সালাম যখন নিজ মায়ের দুধ পান করে ফেললেন তখন ফেরাউন মুসা আলাইহিস সালামের মাকে রাজ-প্রাসাদে থাকার আহবান জানাল, যাতে সঠিকভাবে শিশুর লালন-পালন ও দেখাশোনা হয়। কিন্তু তিনি বললেন, আমি স্বামী ও অন্য সন্তানদেরকে ছেড়ে থাকতে পারি না। শেষ পর্যন্ত এটাই ঠিক হল যে, তিনি শিশুকে নিজ ঘরে নিয়ে যাবেন ও সেখানেই লালন-পালন করবেন এবং রাজকোষ হতে তার মজুরী ও পারিশ্রমিক তাঁকে দেওয়া হবে।
সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর কি অপার মহিমা! তিনি নিজ সন্তানকে দুধ পান করাবেন, আর পারিশ্রমিক (দুশমন) ফেরাউন থেকে পাবেন! মহান আল্লাহ মুসাকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি কি সুন্দরভাবেই না পূর্ণ করলেন।
فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ
একটি মুরসাল হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, যে কারিগর নিজ তৈরি জিনিসের মধ্যে নেকি ও কল্যাণের নিয়ত রাখে, তার উদাহরণ মুসার মায়ের মত; যে নিজ সন্তানকে দুধ পান করায়, উপরন্তু তার উপর পারিশ্রমিকও লাভ করে! (মারাসীলে আবু দাউদ)
এমন বহু কাজ আছে যার বাস্তব পরিণামের কথা অধিকাংশ লোকের অজানা থাকে। কিন্তু আল্লাহর কাছে রয়েছে তার শুভ পরিণামের জ্ঞান। সেই জন্য মহান আল্লাহ বলেছেন-
‘তোমরা যা অপছন্দ কর, সম্ভবতঃ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং তোমরা যা পছন্দ কর, সম্ভবতঃ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২১৬)
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেছেন, ‘এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকে ঘৃণা করছ।’ (সুরা নিসা: আয়াত ১৯)
এই কারণে মানুষের উচিত, নিজ পছন্দ-অপছন্দ দৃষ্টিচ্যুত করে প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করা। কারণ এর মধ্যেই রয়েছে প্রভূত কল্যাণ ও শুভ পরিণাম।
আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা
হজরত মুসা আলাইহিস সালাম মহান আল্লাহর কাছে মানুষ মারার অপরাধে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। অপরাধের জন্য মানুষের প্রার্থনা কেমন হবে তা তুলে ধরে আল্লাহ বলেন-
وَ دَخَلَ الۡمَدِیۡنَۃَ عَلٰی حِیۡنِ غَفۡلَۃٍ مِّنۡ اَهۡلِهَا فَوَجَدَ فِیۡهَا رَجُلَیۡنِ یَقۡتَتِلٰنِ ٭۫ هٰذَا مِنۡ شِیۡعَتِهٖ وَ هٰذَا مِنۡ عَدُوِّهٖ ۚ فَاسۡتَغَاثَهُ الَّذِیۡ مِنۡ شِیۡعَتِهٖ عَلَی الَّذِیۡ مِنۡ عَدُوِّهٖ ۙ فَوَکَزَهٗ مُوۡسٰی فَقَضٰی عَلَیۡهِ ٭۫ قَالَ هٰذَا مِنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّهٗ عَدُوٌّ مُّضِلٌّ مُّبِیۡنٌ قَالَ
‘তিনি শহরে প্রবেশ করলেন, যখন তার অধিবাসীরা ছিল বেখবর। তথায় তিনি দুই ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখলেন। এদের একজন ছিল তাঁর নিজ দলের এবং অন্য জন তাঁর শত্রু দলের। অতপর যে তাঁর নিজ দলের সে তাঁর শত্রু দলের লোকটির বিরুদ্ধে তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল। তখন মুসা তাকে ঘুষি মারলেন এবং এতেই তার মৃত্যু হয়ে গেল। মসা বললেন, এটা শয়তানের কাজ। নিশ্চয় সে প্রকাশ্য শত্রু, বিভ্রান্তকারী। তিনি (মুসা আলাইহিস সালাম) বললেন-
رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
উচ্চারণ : রাব্বি ইন্নি জ্বালামতু নাফসি ফাগফিরলি ফাগাফারা লাহু ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহিম।’
অর্থ : ‘হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সুরা কাসাস : ১৫-১৬)
তিনি (মুসা আলাইহিস সালাম আরও) বললেন-
رَبِّ بِمَا أَنْعَمْتَ عَلَيَّ فَلَنْ أَكُونَ ظَهِيرًا لِّلْمُجْرِمِينَ
উচ্চারণ : রাব্বি বিমা আনআমতা আলাইয়্যা ফালান আকুনা জ্বাহিরাল লিলমুঝরিমিন।’
অর্থ : ‘হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন, এরপর আমি কখনও অপরাধীদের সাহায্যকারী হব না।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১৭)
সে ঘটনায় হজরত মুসা আলাইহিস সালামকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় ফেরাউনের রাজ দরবার। সে সময় মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর সাহায্য লাভে প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ বলেন-
‘অতপর তিনি সেখান থেকে ভীত অবস্থায় বের হয়ে পড়লেন পথ দেখতে দেখতে। তিনি বললেন-
رَبِّ نَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ
উচ্চারণ : ‘রাব্বি নাঝঝিনি মিনাল ক্বাওমিজ জ্বালিমিন।’
অর্থ : ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে জালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে রক্ষা কর।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ২১)
رَبِّ إِنِّي لِمَا أَنزَلْتَ إِلَيَّ مِنْ خَيْرٍ فَقِيرٌ
উচ্চারণ : ‘রাব্বি ইন্নি লিমা আংযালতা ইলাইয়্যা মিন খাইরিং ফাক্বির।’
অর্থ : ‘হে আমার পালনকর্তা, তুমি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ নাযিল করবে, আমি তার মুখাপেক্ষী।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ২৪)
এর পর মুসা আলাইহিস সালাম মাদাইন চলে যান। সেখানে এক চুক্তির মাধ্যমে তিনি আশ্রয়, অবস্থান এবং বিয়ে শাদি করেন। তার পর মেয়াদ শেষ হলে তিনি নিজ দেশে ফিরে আসেন। পথে তুর পর্বতে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন। সেখানে কিতাব ও মুজিজা লাভ করেন। অতঃপর ফেরাউনের কাছে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত ও বনি ইসরাঈলকে মুক্ত করার দাবি জানান।
সুরা আনকাবুত : ০১-৪৪
মক্কায় অবতীর্ণ সুরা আনকাবুত মুশরিকদের প্রতিছিল এক বিশেষ চ্যালেঞ্জ। এ সুরায় আল্লাহ তাআলা মাকড়শার দৃষ্টান্ত দিয়ে শিরকের বাতুলতা প্রকাশ করেছেন। সংক্ষেপে এ সুরা আলোচ্যসূচি তুলে ধরা হলো-
> পাপের প্রতি দাওয়াত দেয়াও পাপ; > কাফেরদের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী; > আল্লাহর অসীম রহমতের বিবরণ; > পৃথিবীর প্রথম হিজরত প্রসঙ্গ; > হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের প্রতি বিশেষ নিয়ামাত; > আল্লাহর নিকট প্রকৃত জ্ঞানী।
সুরা আনকাবুতে আল্লাহ তাআলা হজরত নুহ আলাইহিস সালাম, ইবরাহিম আলাইহিস সালাম, হজরত লুত আলাইহিস সালাম, হজরত শোয়াইব আলাইহিস সালামের ঘটনার উল্লেখ করেন। আজকের তারাবিহের শেষ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
خَلَقَ اللّٰهُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ بِالۡحَقِّ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ
‘আল্লাহ যথাযথভাবে আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন; নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে মুমিনদের জন্য।’ (সুরা আনকাবুত: আয়াত ৪৪)
আল্লাহ তাআলা আসমান ও জমিন যথাযথই সৃষ্টি করেছেন। তিনি কোনো খেলাচ্ছলে তা সৃষ্টি করেননি। (ইবন কাসির) তিনি আসমান ও জমিন ইনসাফ ও আদলের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অথবা আয়াতের অর্থ, তিনি আসমান ও জমিন তাঁর কালেমা ও নির্দেশ দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। অথবা আয়াতের অর্থ, তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, যখন সেটা সৃষ্টি করা ছিল যথাযথ। (ফাতহুল কাদির)
আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর মহাশক্তি, জ্ঞান ও হিকমতের উপর বিশ্বাসীদের জন্য। তারা ঐ প্রমাণ দ্বারা এই পরিণামে পৌঁছতে পারে যে, এ বিশ্ব-জাহানে আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই, দুঃখ মোচনকারী, প্রয়োজন পূর্ণকারী কেউ নেই।
সুতরাং আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের এ গুরুত্বপূর্ণ সুরাগুলো বুঝে পড়ার এবং তাঁর ওপর আমল করার পাশাপাশি নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সুত্র : জাগোনিউজ২৪.কম