নওগাঁয় ইরি-বোরো মৌসুমের ধান কাটা-মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। এবার ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের মুখে যেন হাসির ঝিলিক। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সুষ্ঠুভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারবেন তারা।
তবে চাষিদের দাবি, রোপণ থেকে শুরু করে ধান ঘরে তোলা পর্যন্ত শ্রমিক, সার, কীটনাশক ও জ্বালানির দাম বাড়ায় তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ অবস্থায় কেবল ধানের দাম ভালো পেলেই লাভবান হতে পারবেন।
কৃষি অফিসের তথ্য মতে, এবছর জেলায় ১ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে, যা থেকে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ধান থেকে প্রায় ৮ লাখ ৩৬ হাজার ২৬০ মেট্রিকটন চাল উৎপাদন হবে। ধানের দাম ১ হাজার ৪০০ টাকা মণ হিসেবে যার বাজার মূল্য প্রায় ৪ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা।
উত্তরের জেলা নওগাঁর মাঠে মাঠে দোল খাচ্ছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন। সোনালী ধানের শীষে ভরে উঠেছে বিস্তীর্ণ মাঠ। পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে মুখরিত চারিদিক। ইরি-বোরো মৌসুমের ধান ঘরে তুলতে কাটা-মাড়াইয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন কৃষক-কৃষাণীরা। এবছর জিরাশাইল, ব্রিআর-২৮, ৪৮, সুবর্ণলতা ও হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদ করেছেন চাষিরা। এবছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানে তেমন কোনো রোগবালাই হয়নি। এছাড়া ফলনও হয়েছে ভালো। এবার বাম্পার ফলনের আশা চাষিদের। ন্যায্য মূল্য পেলে এ জেলার মানুষের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আমূল পরিবর্তন ঘটবে।
চাষিরা জানান, সার, কীটনাশক, জ্বালানি তেল ও শ্রমিকের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফসল উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সে হিসেবে জমিতে ধান রোপণ থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রতি বিঘায় প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বিঘাপ্রতি ফলন হচ্ছে প্রায় ২২-২৬ মণ। কোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবং বাজারে ভালো দাম পেলে লাভবান হতে পারবেন তারা। এতে করে তারা গত বছরের প্রাকৃতিক দুর্যোগে বোরো ফসলের যে ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে নিতে পারবেন।
সদর উপজেলার চকপ্রসাদ গ্রামের কৃষক ফিরোজ হোসেন বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। ধানে পোকার আক্রমণ কম হয়েছে। এ কারণে কীটনাশকের খরচও কম হয়েছে। ধান কাটা-মাড়াইয়ের ধুম পড়েছে। শ্রমিক সংকট হওয়ায় মজুরি বেড়েছে। প্রতি বিঘাতে ধান কাটতে খরচ পড়ছে চার হাজার টাকা। জমি থেকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতে আরও এক হাজার টাকা এবং ধান মাড়াই করতে ৫০০ টাকা। ধান রোপণ থেকে শুরু করে ঘরে উঠানো পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ পড়েছে।
একই গ্রামের কৃষক নাহিদ বলেন, প্রতি বিঘাতে ফলন হচ্ছে ২২-২৬ মণ। এবছর সার, কীটনাশক, জ্বালানি তেল ও শ্রমিকের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফসল উৎপাদন খরচ বেড়েছে। খোলা বাজারে ধানের দাম ১৪০০ টাকা মণ হলে আমরা লাভবান হতে পারবো।
সাপাহার উপজেলার পাতাড়ি গ্রাম থেকে সদর উপজেলার দীঘলির মাঠে ধান কাটার জন্য এসেছেন মামুন হোসেন। তিনি বলেন, এ এলাকায় আগেই ধান কাটা শুরু হয়। গ্রাম থেকে ১০ জন আসছি ধান কাটতে। প্রতি বিঘাতে পাঁচ হাজার টাকা মজুরিতে ধান কাটছি। জমি থেকে রাস্তা পর্যন্ত ধান তুলে দিতে হবে। তারপর মালিকরা বাড়ি নিয়ে মাড়াই করছেন। প্রতিদিন আমাদের প্রায় ১২০০-১৫০০ টাকা আয় হচ্ছে।
চলতি বোরো মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এবছর প্রতিকেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ টাকা। এছাড়া সিদ্ধ চাল ৪৪ টাকা এবং গম ৩৫ টাকা। ২০২২ সালে বোরো সংগ্রহ মৌসুমে ধান-চাল ও গমের মূল্য ছিল যথাক্রমে ধান ২৭ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪০ টাকা এবং গম ২৮ টাকা।
নওগাঁ সদর উপজেলা চাউল ও ভূষিমাল আড়ৎদার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সালাউদ্দিন খান টিপু বলেন, এবছর কৃষকদের ধান উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কৃষকরা তাদের ঘরে ধান মজুত করে রাখবে। সেক্ষেত্রে চালকল ব্যবসায়ীদের বাড়তি দামে ধান কিনতে হতে পারে। আবার বিদ্যুৎ ও শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। ধান কিনে চাল উৎপাদন করতে বাড়তি খরচ গুনতে হতে পারে চালকল মালিকদের।
তিনি বলেন, সরকার ধান এবং চালের যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সেখানে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। ধানের দাম বেশি এবং চালের দাম কম মনে হচ্ছে। জেলায় মোটা ধানের উৎপাদন কম। সেক্ষেত্রে সরকারি খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহ করতে লোকসান গুনতে হতে পারে।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বোরো আবাদের জন্য জেলার ৪০ হাজার জন কৃষককে পাঁচ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও পাঁচ কেজি এমওপি সার প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হয়। এবছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এরইমধ্যে পাঁচ শতাংশ ধান কাটা-মাড়াই হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কৃষকরা সুষ্ঠুভাবে ধান ঘরে তুলতে পারবেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে ধান ঘরে তুলতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র : জাগোনিউজ২৪.কম