ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি দেশটির যে রাজ্যটিকে তাদের ‘হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির’ নতুন পরীক্ষাগার করে তুলেছিল, সেটি হলো কর্ণাটক। আজ পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের কেবল এই একটি রাজ্যেই ক্ষমতায় যেতে পেরেছে বিজেপি।
কর্ণাটকে বাসবরাজ বোম্মাইয়ের নেতৃত্বে বিজেপি সরকার সাম্প্রতিককালে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, তার অনেকগুলোই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বা ‘পোলারাইজেশন’র লক্ষ্যে নেওয়া।
যেমন- রাজ্যের স্কুল-কলেজে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামসম্মত ‘হালাল’ মাংস বাজারে বিক্রির ওপরেও বিধিনিষেধ আনা হয়েছে। মহীশূরের সাবেক শাসক টিপু সুলতানকে হিন্দুবিদ্বেষী হিসেবে তুলে ধরতে নতুন করে ইতিহাস লেখার চেষ্টাও বাদ যায়নি।
কর্ণাটকে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১০ মে। তার অল্প কিছুদিন আগে রাজ্য সরকার পশ্চাৎপদ মুসলিমদের জন্য চার শতাংশ কোটা ব্যবস্থাও বাতিল ঘোষণা করেছে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও কর্ণাটকে এই হিন্দুত্বের রাজনীতি বিজেপি’কে আদৌ কোনও নির্বাচনী ফায়দা দিচ্ছে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকরা।
ভোটের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। এই শেষ মুহূর্তে বিজেপিও হিন্দুত্ববাদের রাস্তা ছেড়ে নির্বাচনী প্রচারে শুধু উন্নয়ন আর অবকাঠামোর কথাই বলছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেও ভোটের প্রচারে কর্ণাটক চষে ফেলছেন।
উল্টোদিকে, তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস রাজ্যে খুবই উজ্জীবিত প্রচার চালাচ্ছে। দলের স্থানীয় নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকলেও আপাতত সেসব ভুলে ক্ষমতায় ফেরার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কংগ্রেস নেতারা। সম্প্রতি রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা কংগ্রেসের পালে অনেকটাই হাওয়া ফিরিয়ে এনেছে বলে একমত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
এই পটভূমিতে আগামী বছর ভারতে সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপিকে একটি বড় ধাক্কা দেওয়ার জন্য কর্ণাটকের নির্বাচনকেই বিরাট সুযোগ হিসেবে দেখছেন কংগ্রেস নেতারা।
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা
কর্ণাটকের রাজনীতি মূলত রাজ্যের হিন্দুদের দুটি প্রধান সম্প্রদায়- লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের রাজনীতি। বিজেপি বরাবরই লিঙ্গায়েতদের সমর্থন পেলেও ভোক্কালিগাদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা বেশ কম।
কংগ্রেসে আবার বেশ কয়েকজন বড় মাপের ভোক্কালিগা নেতা রয়েছেন। ফলে ভোক্কালিগা ভোট মূলত কংগ্রেস এবং জনতা দলের (সেকুলার) ঝুলিতেই যায়।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, কর্ণাটকের এই নিজস্ব হিন্দু ‘জাতপাতের রাজনীতি’ শেষ করতেই বিজেপি চেয়েছিল হিন্দু-মুসলিম ভোট ভাগের রাজনীতি করতে, যেন মুসলিম-বিরোধিতার আবেগে লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগারা একাট্টা হয়ে বিজেপিকেই ভোট দেয়।
উত্তর প্রদেশে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ, সেখানে বিজেপির এই ফর্মুলা অতীতে দারুণ কাজে এসেছে। কর্ণাটকেও প্রায় ১৫ শতাংশ জনসংখ্যা মুসলিম।
বেঙ্গালুরুর প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুগত শ্রীনিবাসারাজু বলেন, ঠিক একই ধরনের লক্ষ্য নিয়েই রাজ্যের বোম্মাই সরকার গত দু’তিন বছরে একের পর এক মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে গেছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো দক্ষিণ কর্ণাটকে গত বছরের হিজাববিরোধী আন্দোলন।
বছর দেড়েক আগে থেকেই সেখানকার সব স্কুল-কলেজের সামনে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরে আসার বিরুদ্ধে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে শুরু করে। যার পরিণতিতে একপর্যায়ে ছাত্রীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়, আদালতও তাতে সায় দেয়।
কর্ণাটকে হালাল মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়েও গত বছর থেকে সরব হয় শ্রীরাম সেনা, বজরং দলের মতো নানা গোষ্ঠী। এরপর সেই দাবি অনেকটা মেনে নিয়ে রাজ্য সরকার বিধানসভায় একটি বিল আনারও প্রস্তুতি নেয়।
বিজেপির কর্ণাটক শাখার আর একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ ছিল ‘উরি ও নানজে গৌড়া’র কাহিনী প্রচার করা। ইতিহাসের এই দুই ভোক্কালিগা বীরই মূলত টিপু সুলতানকে হত্যা করেছিলেন, শ্রীরঙ্গপত্তনমের যুদ্ধে ব্রিটিশদের হাতে তার মৃত্যু হয়নি– ভোটের কয়েক মাস আগে বিজেপি এই প্রচারণা শুরু করে।
তবে এই দাবিতে যে কোনও ঐতিহাসিক সত্যতা নেই, বরং এটা স্রেফ ভোক্কালিগা ভোট টানার চেষ্টা– কর্নাটকের পর্যবেক্ষকরা সবাই এ বিষয়ে একমত।
বোম্মাই সরকারের শেষ হিন্দুত্ববাদী পদক্ষেপ ছিল রাজ্যে চার শতাংশ মুসলিম কোটা বাতিল করা। সুপ্রিম কোর্ট ভর্ৎসনা করার পরেও সেই অবস্থানে অনড় রয়েছে তারা।
‘কর্ণাটক সাম্প্রদায়িক নয়’
বাস্তবতা হলো, কর্ণাটকে একের পর একটা হিন্দুত্ববাদী পদক্ষেপ নিলেও ভোটের আগে তা বিজেপিকে বাড়তি অক্সিজেন জোগাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
সপ্তাহখানেক আগে ভারতের একটি জাতীয় টিভি চ্যানেলের উপস্থাপক মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইয়ের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বিজেপির এই হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা নিয়ে প্রশ্ন করেন। এতে দৃশ্যতই বিরক্ত বোম্মাই জবাব দেন, হিজাব আর হালাল ছাড়া আপনারা কি কোনও সাক্ষাৎকার নিতে পারেন না? মানুষ এখন ওসব নিয়ে আর কথা বলছে না।
কর্ণাটকের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, রাজ্যের ভোট যে হিন্দুত্ববাদ নয়, বরং উন্নয়ন আর অবকাঠোমোর প্রশ্নেই আবর্তিত হচ্ছে, তা বুঝে বিজেপিও এখন বিভাজনের রাজনীতির রাস্তা থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে।
সুগত শ্রীনিবাসারাজুর কথায়, রাজ্যের যে ওল্ড মাইসোর এলাকায় বিজেপি এই রাজনীতিটা শুরু করেছিল, সেখানে সাধারণ মানুষের অনেক বেশি মাথাব্যথা ডিজেলের দাম কিংবা কৃষিপণ্যের সঠিক মূল্য পাওয়া নিয়ে।
ইউনিভার্সিটি অব মাইসোরের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মুজফফর আসাদিও মনে করেন, কর্ণাটকের মাটিতে বিজেপির এই সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি কাজ করবে, এটি ভাবা ভুল ছিল। তিনি বলেন, আসলে কর্ণাটকের ডিএনএ-তেই এই সাম্প্রদায়িকতা জিনিসটা নেই। এই রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি শান্তিতে বাস করছে বহুকাল ধরে। এমনকি কর্ণাটকে তেমন কোনও বড় দাঙ্গার ইতিহাসও নেই।
‘এখানে যদি বলাও হয় টিপু সুলতান হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন, মানুষ তা বিশ্বাস করবে না। মহীশূরের লোকজন তাকে চিরকাল পরধর্মসহিষ্ণু শাসক হিসেবেই জেনে এসেছেন।’
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কংগ্রেস?
বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কর্ণাটকে সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মানুষ বোম্মাই সরকারের বিরুদ্ধে বীতশ্রদ্ধ– এটা বুঝেই নতুন উদ্যমে ক্ষমতা দখলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস।
বোম্মাই সরকার প্রতিটি কাজের জন্য ৪০ শতাংশ ‘কমিশন’ বা ঘুস নিয়ে থাকে, এই দাবি করে প্রতিটি জনসভায় রাজ্য সরকারকে ‘ফোর্টি পার্সেন্ট গভর্নমেন্ট’ বলে লাগাতার আক্রমণ করে চলেছেন কংগ্রেস নেতারা।
রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার পর এই প্রথম ভারতের কোনও বড় রাজ্যে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটিও তৃণমূল পর্যায়ের কংগ্রেস কর্মীদের উজ্জীবিত করে রেখেছে।
দিল্লিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঈশাদৃতা লাহিড়ী বলেন, রাহুল গান্ধী, বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বা নতুন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মল্লিকার্জুন খাড়গে একটানা প্রচারে কর্ণাটক চষে ফেলছেন। ডিকে শিবকুমার বা সিদ্ধারামাইয়ার মতো স্থানীয় নেতারা তো রয়েছেনই।
তিনি বলেন, বলা যেতে পারে কংগ্রেস প্রায় কার্পেট বম্বিংয়ের ধাঁচে প্রচার চালাচ্ছে। আর একটা জিনিস হল, আদানির মতো বিষয়ে নয়, তারা জোর দিচ্ছেন একেবারে কর্ণাটকের স্থানীয় ইস্যুতে, যেগুলোর সঙ্গে মানুষ সহজেই রিলেট করতে পারবে।
কংগ্রেস নেতারা প্রকাশ্যে দাবি করছেন, ২২৪ আসনের কর্ণাটক বিধানসভায় তারা এবার অনায়াসেই ১৪০ বা তারও বেশি আসন পাবেন। কংগ্রেসের আত্মবিশ্বাস এতটাই তুঙ্গে যে, দলটি আরও বলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য তাদের এবার অন্য বিরোধী দলগুলোর ভরসাতেও থাকতে হবে না।
আগামী ১০ মে গোটা রাজ্যে অনুষ্ঠিত হবে ভোটগ্রহণ। এর তিনদিন পরে ১৩ মে হবে ভোটগণনা। সেদিনই নিশ্চিতভাবে জানা যাবে কর্ণাটক বিজেপির হাতছাড়া হচ্ছে কি না।
সূত্র :জাগোনিউজ২৪.কম