বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবিত বিনাধান-২৫। এ ধান কৃষকের আয় দ্বিগুণ করতে সক্ষম। গোপালগঞ্জে এ বছর প্রথমবারের পাকিস্তান বা ভারতের বাসমতি টাইপের অতি লম্বা ও সবেচেয়ে সরু ধানের আবাদে সফল্য মিলেছে । চলতি বোরো মৌসুমে গোপালগঞ্জে ১২ টি প্রদর্শনী প্লটে ১২ একর জমিতে এ ধানের চাষাবাদ হয়েছে ।
বিনা উদ্ভাবিত প্রিমিয়াম কোয়ালিটির বিনাধান-২৫ জাতের ধানের ক্ষেতে শুধু ধান আর ধানের সমরোহ। এ ধানের ক্ষেতের ধান দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ধানের বাম্পার ফলন দেখে লাভজনক এ ধানের চাষাবাদ সম্প্রসারণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন গোপালগঞ্জের কৃষক।
তাই বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) আগামী বোরো মৌসুমে গোপালগঞ্জের ২ হাজার কৃষককে দিয়ে এ ধানের আবাদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে।
বিনা গোপালগঞ্জ উপকেন্দ্রের ইনচার্জ ও উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, দেশের চাহিদা অনুসারে সরু ও চিকন (প্রিমিয়াম কোয়ালিটি) চাল অপ্রতুল। বিদেশে রপ্তানির উদ্দেশ্যে বিনার উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ বিনাধান-২৫ উদ্ভাবন করেছে। ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর বিনাধান-২৫ জাত অবমুক্ত করা হয়। তারপর আমরা গোপালগঞ্জে মাঠ পর্যায়ে কৃষককে নিয়ে এ ধানের আবাদ করাই। গোপালগঞ্জে প্রতি হেক্টেরে এ ধান অন্তত ৮ টন ফলন দেবে বলে ক্ষেতের ধান দেখে ধারণা করছি। বিনাধান-২৫ এর চাল বিদেশে রপ্তানিযোগ্য। এ চাল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখবে। এ চাল পাকিস্তান বা ভারত থেকে বাসমতি চাল আমদানি নির্ভরতা কমাবে।
প্রতি কেজি ধান কমপক্ষে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হবে। বিনাধান-২৫ কৃষকের আয় দ্বিগুণ করে দেবে। তাই এ ধান চাষ করে কৃষক লাভবান হবেন।
বিনাধান-২৫ এর গবেষক ড. সাকিনা খানম বলেন, ৮ বছর গবেষণার পর এ সাফল্য এসেছে। বিনাধান-২৫ মূলত ব্রি ধান-২৯ এর বীজে জাপানের একটি ল্যাবে ৪০ গ্রে মাত্রার কার্বন আয়রন রশ্মি প্রয়োগ করে উদ্ভাবন করা হয়েছে। যা চেকজাত ব্রি ধান ৫০ থেকে ১০ শতাংশ ফলন বেশি দিতে সক্ষম। প্রিমিয়াম কোয়ালিটির এ ধান আগাম পাকে। চাষাবাদের ১৩৮ থেকে ১৪৮ দিনেই এ ধান ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা যায়। বিনাধান-২৫ ব্রি ধান-২৯ এর চেয়ে ১৫ থেকে ২০ দিন আগে পাকে। এ ধানের গড় ফলন হেক্টর প্রতি সাড়ে ৭ মেট্রিক টন থেকে সাড়ে ৮ মেট্রিক টন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ধানের জাতের মধ্যে বিনাধান-২৫ সর্বাধিক লম্বা ও সরু আকৃতির। জমিতে পানি জমে থাকা বা বৈরী আবহাওয়ায় প্রচ- ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়ে ধান গাছ সাধারণত সাময়িক হেলে পড়। পরে জমি থেকে পানি সরে গেলে এবং রৌদ্রোজ্জ্বল অবস্থায় বিনাধান-২৫ জাতটি ২-৩ দিনের মধ্যে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে আসে। সেই সঙ্গে স্বাভাবিক ফলন দেয়। এর ধানের চলের ভাত ঝরঝরে ও খেতে সুস্বাদু।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, এধানে রোগ ও পোকার আক্রমণ নেই বললেই চলে। এ ধান চাষে পানি কম লাগে। ইউরিয়া সার সাশ্রয়ী। এ জন্য বিনাধান-২৫ কে ইউরিয়া, পানি ও বালাইনাশক সাশ্রয়ী জাত বলা যায়। ধানের গাছ লম্বা বেশি। তাই কৃষক প্রচুর খড় পাবেন । এ জাতের চাষাবাদ সম্প্রসারিত হলে গো-খাদ্যের সংকট নিরসন হবে । এটি যেমন প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, অল্প জীবনকাল সম্পন্ন আবার ফলনও বেশি দেয়। তাই কৃষক এ ধান চাষে দ্বিগুণ লাভবান হবেন।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, এ পর্যন্ত বিনার বিজ্ঞানীরা ২৬টি ধানের জাত আবিষ্কার করেছেন। এর মধ্যে বিনা ধান-২৫ অতি লম্বা ও সবচেয়ে সরু ধানের জাত। বিশেষ করে এ জাতটি বিদেশে রপ্তানিযোগ্য প্রিমিয়াম কোয়ালিটির চাল দেবে। পাকিস্তান বা ভারতে এ ধরনের বাসমতি টাইপের জাত আছে। এ ধানের বাজারমূল্য প্রচলিত যেকোন ধানের জাতের তুলনায় কৃষক অনেক বেশি পাবেন।
বিনার প্রধান আরও বলেন, আমরা কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ, রপ্তানিমুখী ও প্রযুক্তি নির্ভর করব। আমদানি নির্ভরতা কমাতে ও কৃষকের আয় দ্বিগুণ করে দিতে চাই। সেই জায়গায় বিনাধান-২৫ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ধান আবাদ করলে কৃষক দ্বিগুণ লাভ করতে পারবেন। তাই আমরা গোপালগঞ্জের ২ হাজার কৃষককে দিয়ে আগামী বোরো মৌসুমে এ ধানের আবাদ করাবো। সেই ভাবেই আমরা পরিকল্পনা গ্রহন করেছি। এ ধানের আবাদ করে কৃষক ব্যাপক লাভবান হবেন। কৃষি আধুনিক ও আরো সমৃদ্ধ হবে।
মুকসুদপুর উপজেলার কদমপুর গ্রামের কৃষক মোঃ বাচ্চু শেখ বলেন, আমি কৃষি প্রণোদনা পেয়ে ১০০ শতাংশ জমিতে এ ধানের আবাদ করেছি। এ ধানে রোগ বালাই নেই। সেচ ও সার কম লেগেছে। ধান অতি লম্বা ও সবেচেয়ে সরু । আমি আগামী বছরের জন্য এ ধানের বীজ সংরক্ষণ করব। আমার ক্ষেতে ধানের সমারোহ দেখে অনেক চাষি এ ধান চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
একই গ্রামের কৃষক বশার সিকদার বলেন, আমাদের গ্রামের মাঠে ব্রিধান-২৮সহ বিভিন্ন জাতের হাইব্রিড ও উচ্চ ফলশীল ধানের চাষ হয়েছে। এসব জাতের ধানের চেয়ে বিনাধান-২৫ মোঃ বাচ্চু শেখের ক্ষেতে অনেক বেশি ফলন দিয়েছে। ওই ক্ষেতে শুধু ধান আর ধান। এ ক্ষেত যে দেখছে, সেই এ ধান সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করছে। বাজারে এ ধান প্রতি কেজি ১০০ টাকা দরে বিক্রি হবে। আগামী বছর আমিও লাভজনক এ ধানের চাষ করব।
সূত্র : বাসস