সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাজীপাড়া এলাকায় কৃষক কাজী মিজানুর রহমান এক একর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করছেন চিয়া বীজ। বাতাসে দুলছে লকলকে সবুজ চিয়া গাছ। দেখতে তিল কিংবা তিষির গাছের মতোই। প্রতিটি গাছেই ধরেছে ফুল। ফুলে উড়ছে মৌমাছি। সরিষাখেতের মতোই চিয়া ফুল থেকেও মৌচাষের সম্ভাবনা রয়েছে।
কাজী মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মূলত আখ চাষি ছিলাম। আমরা আখ চাষের ব্যাপারে ইক্ষু গবেষণা ইনিস্টিটিউট রাজশাহীর ঈশ্বরদীতে একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম। সেখানে এক কৃষিবিদের সঙ্গে পরিচয় হলে তার কাছ থেকেই এই ফসলের কথা জানতে পারি। তিনি আমাকে বিদেশি ঔষধি ফসলের গুণাগুণ জানিয়ে চাষ করার আহ্বান জানালে আমি উদ্বুদ্ধ হই। তিনি আমাকে এক প্যাকেট চিয়া সিড (বীজ) উপহার দেন। আমি সেগুলো বাড়িতে এসে লাগাই। প্রথমবার দেখলাম বেশ গজিয়েছে। পরের বার এক একর জমিতে তা বপন করলে ফলন দেখে আশ্চর্য হয়েছি। এটি মূলত দূরারোগ্য ব্যাধি নির্মূলে খুব ভালো কাজ করে। বাজার সুবিধা পেলে আগামীতে আরও বেশি জমিতে এই ফসল আবাদ করব।
জানা যায়, সুপার ফুড হিসেবে খ্যাত চিয়া বীজ। এতে রয়েছে নানান ঔষধি গুণ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘সালভিয়া হিসপানিকা’। মেক্সিকোসহ ইউরোপের দেশগুলোতে ওষুধি ফসল হিসেবে চিয়া চাষ হয়। এ বীজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্লোরোজেনিক, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, কেম্পফেরল, কোয়েরসেটিন ও ক্যাফিক অ্যাসিড নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, দ্রবনীয় এবং অদ্রবণীয় আঁশ। এক আউন্স চিয়ায় রয়েছে প্রায় ৬ গ্রাম প্রোটিন, ১১ গ্রাম ফাইবার, ১৩ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট। এতে দুধের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ক্যালসিয়াম, কলার চেয়ে দ্বিগুণ, পালং শাকের চেয়ে তিনগুণ ও ব্রকলির চেয়ে সাতগুণ পুষ্টি রয়েছে। যা মানবদেহে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাঙ্গানিজের চাহিদা পূরণ করে ও ক্ষতিকারক কোলেস্টরল (এলডিল) হ্রাস করে এবং উপকারি এইচডিএল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে ও ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
চিকিৎসকরা বলছেন, চিয়া সিড মানদেহে শক্তি-কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। ওজন কমায়, রক্তে সুগার স্বাভাবিক রাখে, হাড়ের ক্ষয়রোধ করে, মলাশয় পরিষ্কার রাখে। ফলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। চিয়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়। প্রদাহজনিত সমস্যাও দূর করে।’এটিতে অ্যামিনো অ্যাসিড থাকায় ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে। শরীরের শর্করার মাত্রা কমিয়ে হজমে সহায়তা করে। উচ্চমাত্রার ক্যালশিয়াম থাকায় হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যাথা দূর করে। এছাড়াও নিয়মিত এটি খেলে ত্বক, চুল ও নখ সুন্দর থাকে। এটি ফল বা দইয়ের মতো বিভিন্ন ধরনের খাবারের সঙ্গে খেতে হয়। পানিতে ভিজিয়ে রেখেও খাওয়া যায়। শরবতে ব্যবহার করা যায়। লেবুর রসের সঙ্গে বা দুগ্ধজাত পদার্থের সঙ্গে মিশিয়েও খাওয়া যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চিয়া বীজ বিদেশি একটি ফসল। পুদিনার একটি প্রজাতি। বেলে দো’আঁশ মাটিতে ভালো জন্মে। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চিয়া বীজ বপন করতে হয়। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ফলন তোলা যায়। এটি চাষে উৎপাদনে বেশি ব্যবহার করতে হয় জৈব সার। প্রতি বিঘা জমিতে বীজ উৎপাদন হয়ে থাকে ৭০-৮০ কেজি। বাজারে প্রতি কেজি ৮শ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। উৎপাদন খরচ পড়ে বিঘায় ১০/১২ হাজার টাকা।
তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পঞ্চগড়ে প্রথমবারের মতো বিদেশি ফসল চিয়া সিড চাষ হচ্ছে। এটি খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ ফসল। এটিকে সুপার ফুড বলা হয়। আমাদের সদর ইউনিয়নের মাগুড়া গ্রামের কৃষক মিজান কাজী ১ একর জায়গায় এ ফসলটি চাষ করেছেন। আমরা ম্যানেজমেন্টসহ টেকনিক্যাল বিষয়গুলো যে আছে তাকে পরামর্শ দিচ্ছি। ফসল দেখতে আমি মাঠে গিয়েছি। আশা করছি ভালোভাবে উনি ফসলটি ঘরে তুলতে পারবেন। এটির যে বিশেষ গুণ রয়েছে তা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে উপকারিসহ অনেক রোগের কাজ করে চিয়া সিড। এ ফসল চাষে যাতে আরও কৃষক আগ্রহী হন সে বিষয়েও কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা ও সহযোগিতা করা হবে।
সূত্র :ঢাকা পোস্ট